মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকার ভিড়। রবিবার, কালীঘাটে। নিজস্ব চিত্র
ভোর থেকেই মন্দিরের দু’নম্বর গেটে উপচে পড়েছিল ভিড়। দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন এঁকেবেঁকে গিয়েছিল প্রায় কয়েক কিলোমিটার। মন্দিরের দু’টি গেট শুধু খোলা ছিল। বাকি সব বন্ধ। কিছু জায়গা লোহার রেলিং দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের তরফে ব্যবস্থা বলতে ছিল এটুকুই। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কার্যত হাল ছেড়ে দেওয়া এক পুলিশ কর্মীর মন্তব্য, ‘‘এ যেন ঠিক শনিবারের ভিড়ের অ্যাকশন-রিপ্লে।’’
রবিবার এমনই চিত্র দেখা গেল কালীঘাট মন্দিরে। এ দিন সকাল থেকে রাত ছিল অমাবস্যা-যোগ। সে জন্য মন্দিরের গর্ভগৃহ খুলে রাখার কথা জানিয়েছিলেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। তার উপরে বছরের প্রথম ছুটির দিন। ফলে দর্শনার্থীর ঠাসাঠাসি ভিড় যে হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কিছু দেখেননি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ আধিকারিক। তাঁর কথায়, ‘‘রবিবার গর্ভগৃহ খোলা ছিল। ভিতরে যা পরিস্থিতি, দেখে নিজেরই ভয় করছিল।’’
মন্দিরের ভিতরে গিয়ে দেখা গেল, গর্ভগৃহ-সহ মূল মন্দিরে ঢোকার জন্য দর্শনার্থীরা নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি করছেন। প্রায় কারও মুখে মাস্ক নেই। মন্দিরের একটি সূত্রের অভিযোগ, ভিড় আর ঠেলাঠেলির এই চিত্র দেখা গিয়েছে দিনভর। মন্দিরের ভিতরের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। স্যানিটাইজ়ার টানেল বহু দিন আগেই অকেজো হয়ে গিয়েছে। ভিড়ের চাপে এ দিন সেই গেট প্রায় ভেঙে পড়ার জোগাড় হয়। যে হেতু মন্দিরের সংস্কার চলছে, তাই বেশ কিছু জায়গা টিন দিয়ে ঘেরা। কোথাও আবার লোহার রেলিং দিয়ে ব্যারিকেড করা হয়েছে। কিন্তু এ দিনের প্রবল ভিড়ে সে সব ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। তারই মধ্যে মাস্কহীন শিশুকে কোলে নিয়ে গাদাগাদি ভিড়ে দেখা গিয়েছে অনেককে। মন্দির কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘‘ভিড়ের চাপে দুপুরের সময়সূচি মেনে মন্দির বন্ধ করা যায়নি। ফলে মাকে ভোগ নিবেদনেও প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি হয়েছে।’’ কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা বলছেন, ‘‘এ দিন যে পদপিষ্ট হওয়ার মতো যে বড় কোনও অঘটন ঘটেনি, সেটাই রক্ষে।’’
মন্দির কমিটির আচরণেও ক্ষুব্ধ পুলিশ। তাদের একাংশের অভিযোগ, মন্দির খোলা রাখার বিষয়ে কোনও সুচিন্তিত মতামত নেই। নববর্ষের ভিড় আন্দাজ করে সংক্রমণ ঠেকাতে দক্ষিণেশ্বর মন্দির বন্ধ রাখা হয়েছিল। অথচ কালীঘাট মন্দির কর্তৃপক্ষ কোনও ভাবেই সংক্রমণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। এ দিকে, আলিপুরের জেলা বিচারক-সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন এই মন্দিরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছেন। মন্দির কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন রাজ্যসভার এক সাংসদ। মন্দিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ আধিকারিকদের প্রশ্ন, তার পরেও কেন ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি? সব কিছুর দায় পুলিশের উপরেই কেন চাপানো হবে?
পাল্টা অভিযোগও অবশ্য রয়েছে। মন্দির কমিটির অভিযোগ, শনিবারের মতো রবিবারেও গেটে নজরদারি আর মাইকে ঘোষণা ছাড়া পুলিশের ভূমিকা ছিল ঠুঁটো জগন্নাথের । যা শুনে কালী টেম্পল রোডে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘মাস্ক না পরলে জরিমানা বা গ্রেফতারের নির্দেশ নেই। ফলে সংক্রমণ এড়াতে ভিড় থেকে আমরা নিজেদের সরিয়ে রেখেছি।’’ দু’নম্বর গেট থেকে কিছুটা দূরে হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী। তাঁর কথায়, ‘‘মন্দিরের আশপাশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে খবর আসছে। স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকেই ঘরবন্দি। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বেরোচ্ছেন না। করোনা সংক্রমণে কত পুলিশকর্মী মারা গিয়েছেন, সে হিসাব তো জানা। এমন পরিস্থিতিতে কি কুয়োয় ঝাঁপ দেব?’’
কথায় আছে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। সেই পৌষের খুশিতেই যেন উদ্বেল মন্দিরের সেবায়েতদের একাংশ ও স্থানীয় প্রসাদ এবং ফুল ব্যবসায়ীরা। দিনভর অমাবস্যা থাকায় জবার মালা প্রায় দেড়শো টাকায় বিকিয়েছে। এক ফুল ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘প্রায় হাজারখানেক মালা বিক্রি করেছি। যা দাম চেয়েছি তাই পেয়েছি। গত পাঁচ বছরে এমন ব্যবসা হয়নি।’’ সকাল থেকে হাসিমুখে বিক্রিবাটা করেছেন প্রসাদ ব্যবসায়ীরাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, নববর্ষের দিন ঢালাও বিক্রি হয়েছিল। রবিবারেও ব্যবসা কিছু কম হয়নি।
মন্দিরের এই অব্যবস্থা প্রসঙ্গে মন্দির কমিটির কোষাধ্যক্ষ কল্যাণ হালদার বলেন, ‘‘আমার চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাই মন্দিরে যাইনি। তবে শুনেছি খুব ভিড় হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই মন্দির কমিটির তরফে প্রশাসনিক বৈঠক ডাকা হয়েছে।’’ যার প্রেক্ষিতে কমিটির অন্য অংশের বক্তব্য, ‘‘যা হওয়ার তো হয়ে গিয়েছে। এখন সংক্রমণ মন্দিরের ভিতরের লোকেদের মধ্যেও ছড়াবে। জেলা বিচারকের নজরদারি ও মন্দির কমিটিতে বড় বড় প্রশাসনিক কর্তারা থাকা সত্ত্বেও এমন অব্যবস্থা কেন, সেই উত্তর কে দেবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy