প্রতীকী ছবি।
‘‘আপনাকে নির্দোষ ঘোষণা করে সসম্মানে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিচ্ছি।’’ বিচারকের এ কথা শুনেই এক মুখ দাড়ি, সাদা চুলের মানুষটি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘না, আমি খালাস চাইনে। দাও, ফিরিয়ে দাও, সেই ১২টা বছর!’’
‘সবার উপরে’ সিনেমার শেষ দৃশ্যে ছবি বিশ্বাসের সেই বিখ্যাত সংলাপ আজও মনে রেখেছেন দর্শক। ঠিক সে ভাবেই নিজের জীবনের ১৫টা বছর ফিরে পেতে চান সল্টলেকের বিধান আবাসনের বাসিন্দা তথা রাজ্য অর্থ দফতরের আধিকারিক, বছর পঞ্চাশের ইন্দ্রজিৎ সরকার। তিনি এখন পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরে কর্মরত। বধূ নির্যাতনের মামলায় ওই আধিকারিক এবং তাঁর বাবা-মাকে সম্প্রতি নির্দোষ ঘোষণা করে বেকসুর খালাস করেছে আদালত। ২০০৫ সালে শুরু হয়েছিল সেই মামলা। এক সময়ে আপস মীমাংসার প্রস্তাব এলেও তা নাকচ করে লড়াই চালিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের পথেই হেঁটেছিলেন ইন্দ্রজিৎ।
সিনেমায় প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় (ছবি বিশ্বাস) আদালতে জানিয়েছিলেন, ১২টা বছরে তাঁর জীবন, যৌবন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন সব কবরে চলে গিয়েছে বিচারকক্ষের দেওয়াল চাপা পড়ে। ইন্দ্রজিতেরও যে সেই একই অবস্থা হয়েছিল, সেটাই বলছেন আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এটাও এমন একটা এনকাউন্টার, যাতে ইন্দ্রজিৎবাবু প্রায় ১৫ বছর ধরে রোজ মারা গিয়েছেন। আর গোটা পরিবার ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল।’’ এতগুলো বছর গোটা পরিবারকেই চূড়ান্ত মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ইন্দ্রজিৎ। বলছেন, ‘‘জেল খেটেছি। চাকরিতে সাসপেনশনেও থাকতে হয়েছিল। যত দিন না নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছিলাম, মানসিক শান্তি পাচ্ছিলাম না।’’
ইন্দ্রজিৎ জানান, ২০০৫ সালে নিউ পার্ক গড়িয়া স্টেশন রোডের বাসিন্দা দীপ্তি ধরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর অভিযোগ, কয়েক মাস পর থেকেই বিভিন্ন কারণে অশান্তি শুরু করেন দীপ্তি। এক দিন আচমকাই মাকে খবর দিয়ে বাড়িতে পুলিশ ডেকে আনেন তিনি। তার পরে মা-বাবার বাড়িতে চলে যান। এর দু’দিন পরে বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে জোর করে টাকা আদায় এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন-সহ একাধিক অভিযোগ দায়ের করেন দীপ্তি। ৪৯৮-এ ধারায় শুরু হয় মামলা। মূল অভিযোগকারী দীপ্তি-সহ সরকার পক্ষের আরও পাঁচ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করতেই প্রায় ১৫ বছর লেগে যায়। বিধাননগর মহকুমা আদালতের বিচারক আরফা ইয়াসমিন সম্প্রতি তিন জনকেই বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেন।
রায়ের নথি দেখে জয়ন্তনারায়ণবাবু জানান, মামলায় অভিযোগকারীর সততা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পাশাপাশি, সরকার পক্ষের সাক্ষীদের বয়ানে শুধু যে অসঙ্গতি ছিল তা নয়, ঘটনাটিকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোরও চেষ্টা করা হয়েছে। আদালতে পেশ করা সাক্ষ্য ও নথি থেকে সত্যিটা খুঁজে বার করাও ছিল দুঃসাধ্য। এ ছাড়া, আদালতের আরও পর্যবেক্ষণ, গোটা বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীনই অভিযোগকারী চেষ্টা করেছেন আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করে অন্যায্য দাবি পূরণ করিয়ে নিতে। রায় দিতে গিয়ে বিচারক জানিয়েছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না-ই হতে পারে, তা বলে ৪৯৮-এ ধারার অপব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী দীপ্তি অবশ্য বলছেন, ‘‘আমি শুধু পুলিশে অভিযোগ করেছিলাম। মামলা প্রশাসন করেছে। আর লকডাউনের জন্য রায়ের নথিটা এখনও আমি হাতে পাইনি।’’ সিনেমার প্রশান্ত মনের কষ্টে বলেছিলেন, তিনি আইন-আদালত-ধর্ম-ভগবানে বিশ্বাস করেন না। আর ইন্দ্রজিৎ শুধু বলছেন, ‘‘সত্যমেব জয়তে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy