বিদায়: জীবনের শেষ অনুষ্ঠানে গায়ক কেকে। মঙ্গলবার রাতে, নজরুল মঞ্চে। ছবি: সংগৃহীত
দরদর করে ঘামছেন গায়ক। মাঝেমধ্যেই রুমালে ঘাম মুছছেন। অথচ তখনও তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মঞ্চে উঠে আসা লোকজন। হাওয়া চলাচলের প্রায় কোনও সুযোগই নেই। উপায় না দেখে কয়েক বার মুখ থেকে মাইক সরিয়ে উদ্যোক্তাদের পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করছেন গায়ক। কিন্তু কাজ না হওয়ায় এর পরে মাইকেই বললেন, ‘‘পিঠ জ্বলে যাচ্ছে। কিছু করা না গেলে অন্তত পিছনের দিকের আলোগুলো বন্ধ করে দেওয়া হোক!’’ কাজ হল না তাতেও। উড়তে থাকা ড্রোনের ডানার হাওয়া গায়ে লাগায় মাইকে জানালেন, অন্তত ড্রোনটি যেন তাঁর মাথার উপরেই থাকে। হালকা চালে বলা সেই অনুরোধেও কাজ হল না। ড্রোন চলে গেল অন্য ছবি তুলতে। অগত্যা পরের গান ধরলেন বিখ্যাত বলিউড গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ (কেকে)।
মঙ্গলবার নজরুল মঞ্চে এই অনুষ্ঠানের শেষেই হোটেলে ফিরে মৃত্যু হয় শিল্পীর। প্রবল গরম, চরম অব্যবস্থার মধ্যে গান গেয়ে যাওয়ার এই ভালমানুষিই কি কাল হল?— শোকস্তব্ধ কলকাতার অনুরাগী মহল জুড়ে বুধবার ঘুরপাক খেল এই কথাটাই। সঙ্গীতশিল্পী থেকে চিকিৎসকদের অনেকেই বলছেন, আরও আগে গান থামিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। শারীরিক সমস্যা হচ্ছে বুঝে গান থামিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল তাঁর।
গায়ক লোপামুদ্রা মিত্র যেমন জানালেন, এমন অনুষ্ঠানে উত্তেজনার পারদ বিশাল স্তরে পৌঁছে যায়। তাই এমন অনুষ্ঠান করতে প্রচণ্ড প্রাণশক্তির প্রয়োজন হয়। ‘‘কেকে অত্যন্ত ভাল মানুষ, এর পরেও অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। আমি হলে হয় নেমে যেতাম, নয়তো স্টেজের ভিড়টাকে নামিয়ে দিতাম।’’— বলছেন লোপামুদ্রা। তিনি আরও বলেন, ‘‘আসলে এমন উত্তেজনা, এমন দর্শক পেলে শিল্পী সব সময়েই নিজের সেরাটা দিতে চান। আমিও চিকুনগুনিয়া নিয়ে অনুষ্ঠান করেছি। কেকে-রও হয়তো সেই ভাল লাগাই কাজ করছিল। অনুষ্ঠানের মধ্যেই শুনেছি উনি বলছেন, এখানে যদি মরে যাই তা হলেও দুঃখ নেই। কে জানত, সেটাই সত্যি হবে। গান করতে গিয়ে আমিও কত বার যে এই কথাটা বলেছি!’’
গায়ক রাঘব চক্রবর্তীর অবশ্য দাবি, ‘‘দর্শক-শ্রোতারাই আমাদের জীবন। কিন্তু এমন বহু জায়গায় অনুষ্ঠানে যেতে হয়, যেখানে বসার জায়গাটুকুও থাকে না। ভাল ব্যবস্থাপনা না হলে এমন প্রচণ্ড প্রাণশক্তি দিয়ে অনুষ্ঠান করা যায় না।’’ তবে কী করে আড়াই হাজারের প্রেক্ষাগৃহে সাড়ে ছ’হাজার লোক ঢুকল, সেই প্রশ্ন তুলছেন রাঘব। তাঁর মতে, ‘‘কোনও শিল্পীরই কষ্ট নিয়ে অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাই হোটেলের পরিবর্তে ওঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেই ভাল হত মনে হয়।’’
তবে চূড়ান্ত অব্যবস্থার মধ্যেও যে চাইলেও গান থামানো যায় না, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে কথা হাড়ে হাড়ে জানেন গায়িকা ইমন চক্রবর্তী। ‘‘রোদে পুড়ে, দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যেও অনেক সময়েই অনুষ্ঠান করতে হয় আমাদের। কিন্তু সব সময়ে শিল্পীর পক্ষে দমবন্ধ অবস্থাতেও গান থামিয়ে নেমে যাওয়া সম্ভব হয় না। অতীতে এমন করতে গিয়ে দেখেছি, তার পরে কী পরিস্থিতি হয়!’’— বলছেন ইমন।
হৃদ্রোগ চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদার জানালেন, বহু ক্ষেত্রেই এমন ঘটনার মূলে থাকে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। পঞ্চাশোর্ধ্ব কোনও ব্যক্তির জন্য এমন জীবনযাপন আরও মারাত্মক। এমন অনুষ্ঠান করতে যতটা প্রাণশক্তির প্রয়োজন, তাতে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বাড়তে থাকে। এক সময়ে তা হৃদ্যন্ত্রের উপরে প্রভাব ফেলে। সেই সময়ে দ্রুত অনুষ্ঠান থামিয়ে শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া উচিত। তাঁর কথায়, ‘‘নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করানো গেলে আগাম সতর্ক হয়ে বিপদ এড়ানো সম্ভব।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy