নজরে যাঁরা: মহুয়া মৈত্র, বৃন্দা কারাট, শশী পাঁজা এবং দেবলীনা হেমব্রম। ফাইল চিত্র।
সংসদে ঝড় তুলছেন তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র।
ব্রিগেডে সিপিএমের জনসভা ভেসে যাচ্ছে দেবলীনা হেমব্রমের বক্তৃতায়।
সনিয়া গাঁধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী বা প্রয়াত জয়ললিতার কথা বাদ দিয়েও রাজনীতিতে মহিলাদের উপস্থিতির হাজারো উজ্জ্বল ছবি এখন চারপাশে। তার পরেও পুরভোটের আগে আসন সংরক্ষণ নিয়ে খসড়া তালিকা প্রকাশের পরে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মহিলাদের জন্য ওয়ার্ড সংরক্ষণ-নীতিতে এ বার বাদ পড়তে চলেছেন একাধিক হেভিওয়েট নেতা, মেয়র পারিষদ। কলকাতা পুরসভার ক্ষেত্রেই ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাধারণ ও তফসিলি জাতি মিলিয়ে ৪৮টি ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। কিন্তু ওই সংরক্ষণ নেহাতই ‘প্রতীকী’ বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, তাঁদের দাবি, বহু ক্ষেত্রেই ওয়ার্ডের সমস্ত কাজের দেখভাল, এমনকি, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ফোনে কথা বলার কাজও সংশ্লিষ্ট মহিলা প্রতিনিধির স্বামী, ছেলে বা পার্টির শীর্ষ নেতা করে থাকেন। শুধু পুর বা পঞ্চায়েত স্তরে নয়, মন্ত্রিত্বের ক্ষেত্রেও এমন অভিযোগ ওঠে কখনও-সখনও রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন’-এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, মন্ত্রী পদে কোনও মহিলা দায়িত্বে রয়েছেন সেই নিরিখে ভারতের অবস্থান অনেকটাই নীচে। বিশ্বের মধ্যে ৭৮তম স্থানে ভারত, যেখানে ‘মিনিস্টিরিয়াল পজ়িশন’-এ মহিলাদের উপস্থিতির হার ২৩.১ শতাংশ। ভারতের আগে কিউবা, ঘানা, হন্ডুরাস, উগান্ডার মতো একাধিক দেশ রয়েছে। ২০১৭ সালেও ওই রিপোর্ট অবশ্য একই ইঙ্গিত দিয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, দেশের জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ মহিলা হলেও রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার খুবই নিম্নগামী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর প্রশ্ন, এ রাজ্যে পুরসভা-পঞ্চায়েতগুলিতে মহিলাদের সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল তো সেই ১৯৯৩ সাল থেকে। কিন্তু তাতে সমাজে মহিলাদের অবস্থার কি বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়েছে? তিনি বলেন, ‘‘যে মহিলারা সংরক্ষণের কারণে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন, তাঁদের তো চালনা করেন তাঁর স্বামী বা ছেলে। যেখানে স্বামী বা ছেলে থাকেন না, সেখানে দুর্বলতম মহিলাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করানো হয়, যাতে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ রাজ্যে বর্তমান সরকারের আমলে পার্টি-পরিবার শুরু হয়ে গিয়েছে। এতে সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রতীকীই থেকে গিয়েছে।’’
আর এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কথায়, ‘‘রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও জড়িত। কিন্তু মহিলাদের উপযুক্ত শিক্ষা বা কাজের সুযোগ না দিলে সে ক্ষমতায়ন হবে কী ভাবে? আমরা যদি শুধুমাত্র কলকাতা পুরসভার কথাই ধরি, তা হলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে কী ভাবে শুধুমাত্র খাতায়কলমেই কোনও মহিলা জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন, কিন্তু তিনি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন পিতৃতন্ত্রের দ্বারাই।’’
সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য বৃন্দা কারাট অবশ্য বলছেন, ‘‘রাজনীতিতে পুরুষদের সমান সংখ্যক মহিলাদের অংশগ্রহণই এই পিতৃতান্ত্রিক ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে যে তাঁদের জায়গা শুধুই ঘরে, কোনও নির্বাচিত পদে নয়। এটা রাজনীতিতে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি ভাঙতে সাহায্য করেছে।’’ কিন্তু একাধিক মহিলা জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে কেন তাঁদের স্বামী বা ছেলেরাই ওয়ার্ডের কাজ দেখভাল করেন, সে প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য তিনি কিছু বলেননি। এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজেরও উত্তর দেননি। রাজ্যের শাসক দলের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলছেন, ‘‘যোগ্য হিসেবেই মেয়েরা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁরাই ওয়ার্ডের কাজকর্ম দেখভাল করছেন। অন্তত এ রাজ্য বা কলকাতা পুরসভার ক্ষেত্রে আমি এমনটাই বলতে পারি।’’
গত বছরের গোড়ায় ব্রিগেডে সিপিএম নেত্রী দেবলীনা হেমব্রমের বক্তৃতার পরে হাততালি থামতেই চাইছিল না। উপস্থিত নেতা-কর্মীরা জানিয়েছিলেন, এমন জ্বালাময়ী বক্তৃতা তাঁরা বহু দিন শোনেননি। সেই দেবলীনা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘মেয়েদের অনেক কিছু সামলে তার পরে বেরোতে হয়। সেই দিক থেকে পুরুষেরা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন। কিন্তু তার পরেও এ কথা মানতে পারছি না যে মেয়েদের চালনা করেন পুরুষেরা। এমন অভিজ্ঞতা আমার অন্তত নেই।’’
এ শহরের একাধিক ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংরক্ষণের জন্য কোনও মহিলা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও একাধিক ক্ষেত্রে নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা সংশ্লিষ্ট মহিলার স্বামী বা ছেলেকেই জানাতে হয়। বহু ক্ষেত্রে মহিলা সংরক্ষণের আগে ওয়ার্ডে স্বামী বা ছেলেই হয়তো ক্ষমতায় ছিলেন। ব্যতিক্রম অবশ্য থাকতেই পারে। কিন্তু সেগুলি ব্যতিক্রমই। অভিযোগ মানতে চাননি ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর মৌসুমী দে। এর আগের পুর নির্বাচনের সময়ে ওই ওয়ার্ডটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়। মৌসুমী বলেন, ‘‘মিছিলে লোক জোগাড় করা থেকে শুরু করে এলাকার উন্নয়ন পর্যন্ত সমস্ত কাজ তো আমিই করি। অন্য কারও করার প্রশ্নই ওঠে না।’’
গত পুর নির্বাচনে ৭১ নম্বর ওয়ার্ডও মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। যার কাউন্সিলর হলেন পাপিয়া সিংহ। অভিযোগ, তাঁকে ফোন করলে বেশির ভাগ সময়েই ফোন ধরেন তাঁর স্বামী বাবলু সিংহ। শনিবারও বাবলুই বলেন, ‘‘ওঁর ফোন তো আমিই ধরি। আপনারা যে ভাবে চান এর ব্যাখ্যা করুন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy