প্রতীকী চিত্র। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
‘‘তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)/ তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম/ তার বদলে মাত্র পঁচাশি!/ পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?’’
এই প্রশ্ন বয়সে একেবারেই নবীন নয়। হঠাৎ করে ভুঁইফোড় উঠে আসা সমস্যাও নয়। বাংলা কবিতায় জয় গোস্বামী যখন এই পঙ্ক্তি লিখছেন, তখন ১৯৯৫। ১৯ নভেম্বর, ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে বাঘাযতীনের স্কুলছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে দিল, যত দিন যাচ্ছে ততই এই প্রশ্নের আয়ু চড়চড়িয়ে বাড়ছে। ‘কেন কম’-এর হিসেব বোঝাতে ব্যর্থ হয়েই ঝরে যাচ্ছে আরও অনেক রোহন রায়।
সম্প্রতি ইস্টবেঙ্গল সাব জুনিয়রে ডাক পেয়েছিল ফুটবল দুরন্ত ছেলেটা। তার পরেও সেই সুযোগের ঘরে নিজের হাতেই তালা ঝুলিয়ে দিল নাকতলা হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র রোহন। দিনরাত পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মায়ের খটামটি, দাদার সঙ্গে তুলনা, স্কুলের শাসন, সেখানেও প্রতিতুলনা, পড়াশোনার দোহাই দিয়ে খেলাধুলোয় বাধা— সবটা নিয়েই বারো বছরের ছোট্ট জীবনটাও অসহ্য হয়ে উঠেছিল রোহনের কাছে। গত মঙ্গলবার রাতে নিজের ঘরে ঢুকে তাই মায়ের শাড়ি জড়িয়ে নিজেকে শ্বাসরোধ করে খুন করে সে।
আরও পড়ুন: খেলায় দুরন্ত,পড়াশোনায় নয় কেন! বাড়ির গঞ্জনায় আত্মঘাতী বাঘাযতীনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র
শিশুদের মনোবৃত্তি, তাদের প্রতি স্কুল ও পরিবারের দায়িত্ব, এ সব নিয়ে কর্মশালা কম হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি স্কুলের আচরণ, তাদের শাসনবিধি সব নিয়েই কড়া আইন প্রণয়ন করেছে রাজ্য সরকার। সচেতন করা হয়েছে সব ধরনের স্কুলকে। তার পরেও আইনের এবং বোধের ফাঁক গলে বহু প্রাণই অকালে ঝরে যাচ্ছে। জি ডি বিড়লায় দশম শ্রেণির মেধাবিনী থেকে শুরু করে, পরীক্ষা এগিয়ে আনায় মধ্য কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রের মেট্রোয় ঝাঁপ— সাম্প্রতিক অতীতে তিন তিনটি ছাত্র আত্মহত্যার ঘটনাই বুঝিয়ে দিচ্ছে আইন ও তা প্রয়োগের গাফিলতির কথা।
‘আইন’ করে শিক্ষার্থীর প্রতি স্কুলের মনোভাবকে ‘রিফাইন’ করার যে প্রয়োজনীয়তা এ যুগে দরকারি হয়ে পড়েছে, সেই প্রয়োজনকেই কাঠগড়ায় তুলছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তাঁর মতে, ‘‘স্কুল-কলেজ ও বাড়ি শিক্ষার্থীর কাছে ঘরোয়া ও আপন হয়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। আইন করে বাবা-মায়ের ভালবাসা প্রতিষ্ঠা করা যেমন দুর্ভাগ্যের, আইন করে স্কুলের মনোভাব নির্দেশ করে দেওয়াও তেমনই যন্ত্রণার। কিন্তু স্কুলের পরিবেশ, বাড়ির পরিবেশ আজকাল এতই ভয়াবহ যে আইন প্রণয়নে বাধ্য হতে হচ্ছে।’’ বাবা-মায়েরা সন্তানের অন্যান্য গুণের দিক বিকশিত হতে না দিয়ে তাদের কেবল পড়াশোনা করার যন্ত্র ভেবে বসছেন বলেও তিনি চিন্তিত।
ভারী ব্যাগের ভারে নুয়ে পড়া হতাশ মুখ, বাড়ি ও স্কুলে চাপের জাঁতাকল, পড়াশোনার সঙ্গে অন্যান্য বিষয় শেখা নিয়েও অসুস্থ প্রতিযোগিতা, খেলাধুলোয় আগ্রহ থাকলে তা নস্যাৎ করে দিয়ে বই-মুখে করে রাখার প্রবণতা নিয়ে সমাজের নানা স্তরে নানা ভাবে প্রতিবাদ হয়েছে। কখনও গান, কখনও সিনেমা কখনও বা বিদ্বজ্জনদের কলমে সেই সচেতনতার বার্তা ঠিকরে বেড়িয়েছে। কিন্তু লাভের লাভ হচ্ছে কী?
গোটা শিক্ষাব্যবস্থার বদল না ঘটলে এই অবস্থার কোনও দিনই পরিবর্তন হবে না বলে মনে করেন ‘মন দিয়ে লেখাপড়া করে যেই জন...’-এর গায়ক নচিকেতা চক্রবর্তী। তাঁর সাফ বয়ান, ‘‘এই শিক্ষায় আদতে কিছু হয় না, তাই এই ব্যবস্থার বদল ঘটানো খুব দরকার। সরকারের উচিত একেবারে এই শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচেটাই বদলে দেওয়া। আর মা-বাবারা তো সন্তানের উপর তাঁদের অসাফল্যকে চাপিয়ে দেন, চান বাচ্চারা সেই অসমাপ্ত কাজগুলো করুক। এটা অত্যন্ত অমানবিক। এদেরও শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।’’
আরও পড়ুন: গাউনে আঁটা ৭৬টি সোনার কাঠি! অভিনব পাচারের কায়দায় স্তম্ভিত শুল্ক বিভাগের কর্তারাও
বাড়ির চাপের সামনে নতিস্বীকার, স্কুলের ইঁদুরদৌড়ে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পারার ব্যর্থতা, প্রিয় বন্ধুদের কাছে ব্রাত্য হয়ে যাওয়া সবটাই রোহনের মতো বয়সকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করায় বলে মত মনোবিদদেরও। তাঁদের সঙ্গেই সহমত পোষণ করেছেন এই বিষয় নিয়ে ১৯৯৫ সালে ‘টিউটোরিয়াল’ লেখা জয় গোস্বামী। এই খবর তাঁর কাছে যতটা বেদনার, ততটাই শঙ্কারও। এই ধরনের ঘটনার ঘনঘটা যে ২০১৯-এ দাঁড়িয়েও এতটুকু কমেনি তার নেপথ্যে অভিভাবকদেরই মূলত দায়ী করছেন তিনি। ‘‘তুলনার মধ্যে দিয়ে আমি নিজে এক সময় গিয়েছি। তাই জানি, এই তুলনা যে কোনও বয়সেই এক জনের মনে কতটা বিরূপ চাপ ফেলতে পারে। আসলে প্রতিনিয়ত শিশুরা তাদের মা-বাবার চাহিদা পূরণ করতে তটস্থ থাকছে। এটা দুর্ভাগ্যের যে বেশ কিছু পরিবারে বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে পুঁজি বা লগ্নি হিসেবে দেখছেন। আমি এক মা-কে এমনও বলতে শুনেছি, ‘আমার ছেলের কাছে শুধু নম্বর চাই, আর কিছু নয়।’ এমন মানসিকতাই শিশুদের আত্মধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।’’
খেলাধুলোয় তুখড়, লেখাপড়ায় মোটে মন নেই। বাড়িতে তা নিয়েই মূল আপত্তি। রোহনের জীবনের এই ঘটনার হুবহু ছাপ ছিল হরনাথ চক্রবর্তী পরিচালিত ছবি ‘চলো পাল্টাই’-এ। বাবা-ছেলের মধ্যে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দূরত্ব, ছেলের জেদ বনাম বাবার জেদ অবশেষে ছেলের মৃত্যুর শিয়রে বসে বাবার ভুল বুঝতে পারা, তার পর তাঁদের মিলমিশ— এই ছিল ছবির প্রতিপাদ্য। রোহনের জীবনের সঙ্গে যা প্রথমাংশে মিললেও নিয়তির পরিহাসে দ্বিতীয়াংশ আর কোনও দিনই এক রকম হবে না। সেই ছবির পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীর ছোট ছেলেও এক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র। পড়াশোনার বেশ চাপ। ছবিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় তুললেও বাস্তব জীবনে তিনিও অন্যান্য অভিভাবকদের মতোই এই শিক্ষাব্যবস্থার কাছে অসহায়। তবে ছেলে-মেয়ের চাহিদার প্রতি বাবা-মায়ের নজর ও যত্ন থাকা একান্ত আবশ্যক বলেই মনে করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘অসহায়ের মতোই এই ব্যবস্থার কাছে মাথা নত করেছি। এই সব মৃত্যুর খবর নিজেদেরকেই কাঠগড়ায় তোলে, শিউড়ে উঠি। প্রত্যেক মা-বাবার উচিত তাঁর সম্তানের বন্ধু হওয়া। তাঁর অন্য গুণগুলোকে মর্যাদা দেওয়া।’’
পড়াশোনা জরুরি ঠিকই, তবু সেই চাপে কোনও প্রাণ অকালে চলে গেলে তা খুব দুঃখের বলে মনে করেন এই ছবিতেই বাবার ভূমিকায় অভিনয় করা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও। তাঁর মতে, ‘‘পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের নিজস্ব গুণ ও সেই সব প্রতিভার বিকাশ ঘটানোটাও সমান জরুরি। পড়াশোনায় কম নম্বর পেয়েও জীবনে বড় হওয়া যায়, প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় নানা ভাবে, এটা অভিভাবকদেরই বুঝতে হবে।’’
আরও পড়ুন: মিলন রাতে ‘সতীত্ব’ প্রমাণে কৃত্রিম রক্তের পিল অনলাইনে! নিন্দার ঝড় সমাজ জুড়ে
তবে এমন ঘটনায় স্কুলের ভূমিকাকেও সমান দায়ী করছেন আর এক শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘সন্তানকে একশো পেতেই হবে, সকলকে প্রথম হতে হবে এই চাপ যেমন বাড়ি থেকে আসে, স্কুলেও তেমন ভাল ছেলেদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, যে কোনও অন্যায়ে প্রথমেই পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়াদের দায়ী করা এগুলোও মনের উপর প্রভাব ফেলে। রীতিমতো কড়া পদক্ষেপে এ সব অন্যায় বন্ধ করা উচিত। বোঝা উচিত জীবনের কোনও পরীক্ষার নম্বর তাঁর সন্তানের প্রাণের চেয়ে দামী নয়।’’
যে সময় স্নেহ, প্রশংসা, একটু ভাল ব্যবহার জীবনের বাঁককে একেবারে অন্য পথে চালিত করতে পারত, সেই সময়ে বাড়ি আর স্কুলের যৌথ চাপ ও শাসনে খাপ খাওয়াতে না পেরে জীবনকে কৈশোর পেরতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে রোহনকে যে অনেকটা যুদ্ধ নিজের সঙ্গেও করতে হয়েছে তা খুব স্বাভাবিক। শিশুমনে এমন ভাবনার অঙ্কুরোদ্গমে শঙ্কিত রাজ্য সরকারের শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগের বিশেষ উপদেষ্টা সুদেষ্ণা রায়। ‘‘বাবা-মা , স্কুল সকলকেই আমরা নিত্য সচেতন করে চলেছি। গণমাধ্যমও এই নিয়ে লেখালিখি যেন থামিয়ে না দেয়। এখনও সমাজের নানা স্তরে, বিশেষত শহুরে বিত্তবান ও প্রতিষ্ঠিত বৃত্তেই এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। রোহনের চলে যাওয়া সত্যিই খুব দুঃখজনক। এই মৃত্যু আমাদের আরও এক বার বুঝিয়ে দিয়ে গেল সচেতনতার অভাব এখনও কতটা স্পষ্ট। পড়াশোনাই যে শুধু প্রতিষ্ঠা এনে দেয় না, এটা এ বার বোধ হয় সময় হয়েছে বোঝার।’’
তার চলে যাওয়া আদৌ কোনও বার্তা সমাজের কাছে পৌঁছে দেবে কি না, এত কিছু নিয়ে যদিও আর চিন্তিত নয় রোহন। মৃত্যুর পরের জীবনে যদি কোনও ফুটবল মাঠ থাকে, তা হলে সেখানে কি নিশ্চিন্তে বল দাপাতেই এই কঠিন সিদ্ধান্ত একটু একটু করে নিয়ে ফেলল রোহন? জীবনে যাঁর বাৎসল্যের রস নিয়ত খুঁজেও সে ব্যর্থ, সেই মায়াঘন গন্ধকে নাকে মেখে চলে যেতে চেয়েই কি মায়ের শাড়িকেই বেছে নিল গলার ফাঁস হিসেবে? রোহনদের চলে যাওয়া এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি আবারও দাঁড় করবে আমাদের। উত্তর আসবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy