১০, বিধান সরণিতে নবগোপাল মিত্রের বাড়ির বর্তমান অবস্থা। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
তেতলা বাড়িটির নীচে মনসা মন্দির। আগামী বুধবার মনসা পুজোর পোস্টার লাগানো বাইরের দেওয়ালে। তার পাশেই পাঞ্জাবিদের হোটেল। ফলে ভুল ঠিকানায় আসা হয়েছে, মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
‘‘কাকে খুঁজছেন?’’— স্থানীয় এক বাসিন্দার প্রশ্নের উত্তরে নাম বলায় জবাব এল, ‘‘ওই নামে তো এখানে কেউ থাকেন না।’’ বলা হল, এখনকার কথা নয়। পুরনো কলকাতার কথা। ততক্ষণে সেখানে জড়ো হওয়া স্থানীয়দের এক জন, ৬৭ বছরের প্রণব ঘোষ বললেন, ‘‘এই এলাকায় অতীতের বহু নামজাদা লোকের বাস ছিল। কিন্তু সে সব কথা বলবেন, এমন লোকেরা এখন আর কেউ নেই।’’
ফলে ১০ নম্বর বিধান সরণি (আগে যা ছিল ১০ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিট) ঠিকানার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কারও পক্ষে এটা জানা সম্ভব নয় যে, এই বাড়ির মালিক, নবগোপাল মিত্রই বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ‘ন্যাশনাল’ শব্দটি চালু করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থে লিখছেন— ‘নবগোপাল মিত্তির আসতেন, সবাই বলতেন ন্যাশনাল নবগোপাল, তিনিই সর্বপ্রথম ন্যাশনাল কথাটার প্রচলন করেন। তিনিই চাঁদা তুলে ‘হিন্দুমেলা’ শুরু করেন।’ অবনীন্দ্রনাথ আরও লিখছেন— ‘হিন্দুমেলার উদ্দেশ্যই ছিল ভারতপ্রীতি... নবযুগের গোড়াপত্তন করলেন নবগোপাল মিত্তির।... বঙ্গ বলে কথা ছিল না তখন। ভারতীয় ভাবের উৎপত্তি হল ঐ তখন থেকেই, তখন থেকেই সবাই ভারত নিয়ে ভাবতে শিখলে।’
‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখছেন— ‘নবগোপাল মিত্র মহাশয় এই মেলার (হিন্দুমেলা) কর্মকর্তারূপে নিয়োজিত ছিলেন। ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম হয়।’
কিন্তু আজ, স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে খোদ কলকাতায় নবগোপালের কথা বলতে পারবেন হাতে গোনা কয়েক জন। কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক বলছেন, ‘‘আজ জাতীয়তাবাদ নিয়ে এত কথা হলেও যে মানুষটি ন্যাশনাল শব্দটি চালু করলেন, তাঁর কথা স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে কেউ এক বার উচ্চারণ করছেন না!’’ অথচ সে সময়ের পত্রপত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে, নবগোপাল মিত্র ‘ন্যাশনাল’ নাম দিয়ে স্কুল, প্রেস, সোসাইটি, জিমন্যাসিয়াম, থিয়েটার, এমনকি, সার্কাসও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইতিহাসের একটি সূত্র জানাচ্ছে, তাঁর জন্মকাল ১৮৪০। মতান্তরে তা ১৮৪১। তিনি প্রয়াত হন ১৮৯৪ সালে।
কিন্তু কে আর সে সব মনে রাখে? স্থানীয়েরাই জানালেন, হাতবদলের পরে বাড়িটির বর্তমান মালিক এক জন অবাঙালি। বাড়ির এক সময়ের মালিক নবগোপাল-প্রসঙ্গে বাড়িটির বর্তমান ভাড়াটে, মনসা মন্দিরের কর্তা চন্দ্রকান্ত আচার্য বললেন, ‘‘এ সব ইতিহাসের কথা আমরা কী করে জানব!’’ পাশ থেকে তাঁর স্ত্রী আরতি আচার্য যোগ করলেন, ‘‘পুরসভা হয়তো বলতে পারবে।’’
অথচ কলকাতা পুরসভার ২০০৯ সালের হেরিটেজ তালিকায় নবগোপালের বাড়ি এখনও ‘পেন্ডিং’ বিভাগে। আবার গত ৪ অগস্ট পুরসভার ‘আপডেটেড’ ঐতিহ্য-তালিকা জানাচ্ছে, ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর এই বাড়িটির ‘গ্রেড থ্রি’ পরিবর্তন করে একে ‘পেন্ডিং’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ বাড়িটি ঐতিহ্যশালী হিসাবে ঘোষিত হওয়া নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।
যার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্য গবেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, কলকাতার ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব পুর প্রশাসনের। এ বার তারাই নবগোপালের বাড়িকে ঐতিহ্যের মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে শহরবাসীর আর দোষ কোথায়? হরিপদের আক্ষেপ, ‘‘শহরের ইতিহাস, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষদের সবাই ভুলে যাবে এ ভাবে!’’
তবে এই বিস্মরণ আকস্মিক নয়। কারণ, নাট্যকার অমৃতলাল বসু তাঁর স্মৃতিচারণায় সেই কবেই বলেছিলেন— ‘আজ আমরা পত্রিকার স্তম্ভে কিংবা বক্তৃতার আসরে তাঁহার নাম (নবগোপাল মিত্র) ভুলেও মুখে আনি না; কিন্তু একদিন তিনি কলিকাতার বাঙ্গালী যুবকদিগের নেতৃস্বরূপ ছিলেন।... এই ন্যাশনাল শব্দটা বাঙ্গালীর মধ্যে তিনিই প্রথমে ভাল করিয়া জনসমাজে চালাইয়া যান।’’
কিন্তু তাতে কী? বাঙালি ভুলতে ভালবাসে। তাই ১০, বিধান সরণির ঠিকানায় এখন মনসা মন্দিরের দেখা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ‘ন্যাশনাল নবগোপাল’-এর কোনও চিহ্ন বা স্মৃতি? কোত্থাও নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy