এই শহরে একাধিক সরকারি প্রকল্পের জোরে এই মুহূর্তে যে কোনও ব্যক্তি মাসে অন্তত তিন হাজার টাকা পেতে পারেন। রয়েছে কম দামে খাদ্যদ্রব্য পাওয়ার সুযোগও।
সাহায্যপ্রার্থী: ধর্মতলায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী
তাঁর নামে পাঁচটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ছিল বেশ কিছু টাকা। দু’টি বেসরকারি ব্যাঙ্কে ‘ফিক্সড ডিপোজ়িট’। ছিল জীবন বিমা এবং ডাকঘরের সঞ্চয়ও। এ ছাড়াও বাড়িতে ছিল নগদ হাজার পনেরো টাকা, তিনটি সোনার আংটি এবং একটি ‘টাচ স্ক্রিন’ মোবাইল ফোন! সব মিলিয়ে সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। আজীবন ভিক্ষা করা, ক্যানাল ইস্ট রোডের ভাঁড়পট্টির বাসিন্দা সুধীর দত্তের মৃত্যুর পরে তাঁর এই সম্পত্তির সন্ধান পেয়ে বছর চারেক আগে আকাশ থেকে পড়েছিলেন দুই ছেলে। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়াতে না পারায় বাবার সঙ্গে শেষের দিকে তাঁরা যোগাযোগই রাখেননি।
কিন্তু এত টাকা কোনও ভিক্ষাজীবীর কাছে আসে কী করে? রহস্যের গন্ধ পেয়ে তদন্তে নেমেছিল মানিকতলা থানার পুলিশও। তবে রহস্যজনক কিছুই মেলেনি। বরং জানা গিয়েছিল, কোনও চাকরি বা ব্যবসা করতেন না সুধীরবাবু। কোনও রকম প্রতারণা, তোলাবাজি বা ফাটকার পথেও হাঁটেননি তিনি। ওই সম্পত্তি তিনি করেছিলেন শুধু ভিক্ষা করেই। সেই সময়ে তদন্ত করা এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘বাড়িতে রান্নার পাট ছিল না। ফুটপাথের হোটেলেই ছিল বিনা পয়সায় খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রতিদিন ময়লা, ছেঁড়া পোশাক পরে বেরিয়ে পড়তেন বৃদ্ধ। ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা ধরে ধরে হাঁটতেন। মুখ-চোখ এতটাই শীর্ণকায় ছিল যে, মনে হত কোনও গভীর অসুখে ভুগছেন। ওইটাই ছিল ‘ইউএসপি’। যত দূরেই চলে যান, ঠিক ফিরে আসতেন নিখরচায়। বৃদ্ধ ভিখারির কাছে ভাড়া চাইবে কে? শান্ত ভঙ্গিতে হাতটা বাড়িয়ে দিলে ক’জনই বা মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারেন?’’
শুধু ওই বৃদ্ধই নন, এই কায়দায় শহর জুড়ে অনেকেই ভিক্ষা করেন বলে খবর। একাধিক সরকারি প্রকল্পে সাহায্য পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তা নিয়ে তাঁদের বেশির ভাগেরই উৎসাহ নেই। উল্টে রয়েছে নিজেদের ইচ্ছেমতো ১০-১৫-২০ টাকার ভিক্ষার ‘রেট চার্ট’! কেন্দ্রের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের মধ্যে ভিখারির সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ উপরের দিকে। ২০১৮-২০১৯ সালে দেশে ভিখারির সংখ্যা ছিল চার লক্ষ ১৩ হাজার ৬৭০। সেখানে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ভিখারির সংখ্যা ৮১ হাজার ২২৪। এর পরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (৬৫৮৩৫ জন) এবং অন্ধ্রপ্রদেশ (৩০২১৮ জন)। অনেকেই মনে করছেন, লকডাউনের পরে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সূত্রের খবর, প্রতি মাসে এ দেশে প্রায় ৪০ হাজার শিশু অপহৃত হয়। দেশে রোজ প্রায় তিন লক্ষ শিশু হয় নেশার কবলে পড়ে, আর তা না-হলে ভিক্ষা ব্যবসায় ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু এই শহরে একাধিক সরকারি প্রকল্পের জোরে এই মুহূর্তে যে কোনও ব্যক্তি মাসে অন্তত তিন হাজার টাকা পেতে পারেন। সঙ্গে রয়েছে কম দামে খাদ্যদ্রব্য পাওয়ার সুযোগও। রয়েছে গৃহহীনদের জন্য সরকারি ‘শেল্টার হাউস’। তা সত্ত্বেও ভিক্ষা করার দিকে ঝোঁক কেন? শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন ও শ্রম দফতরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, ভিক্ষা করা অনেক ক্ষেত্রেই একটি সংগঠিত পেশার আকার নিয়েছে। রীতিমতো চরিত্র ধরে ধরে ভিক্ষুক বাছা হয়। কোলের সন্তানকে ভিক্ষার কাজে ভাড়া দিলে মেলে দৈনিক ২০০ টাকা। শিশুদের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করলে দৈনিক ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পাওয়া যায়। রুগ্ণ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার ‘রেট’ আরও বেশি। সব মিলিয়ে মাসে ২৪-২৫ হাজার টাকার ভিক্ষা করার ‘কাজ’ ছেড়ে ক’জনই বা কম টাকার সরকারি প্রকল্পে বাঁচতে চান? রাজ্য সরকারের সহযোগী সংস্থা চাইল্ড লাইনের এক কর্মীর মন্তব্য, ‘‘সব চেয়ে বেশি ভুগছে ছোটরা। শিশু-কিশোর শ্রম নিয়ন্ত্রণ ও বিচার আইনের ২০১৬ সালের সংশোধনীতে আরও কড়া পদক্ষেপের কথা বলা হলেও কাজ হচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি আরও ভাল ভাবে কার্যকর করা গেলে হয়তো বা ভিক্ষা বা শিশুশ্রম সহজে বন্ধ হত।’’
সহজে আয়ের হাতছানিতেই কি তা হলে এই পথে আসছেন ভিক্ষাজীবীরা? সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, ‘‘প্রতিপত্তি হচ্ছে দেখে ভিক্ষা করার পথে হাঁটছেন, এমন মানুষ যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন নিরুপায় মানুষও। যাঁদের কাছে হয়তো ভিক্ষা করাই একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার মনে হয়, তরুণ প্রজন্ম যত বেশি করে বাবা-মা বা পরিবারের অন্য বয়স্কদের দায়িত্ব নেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে, ততই বাড়ছে ভিক্ষা করার উপরে নির্ভরতা।’’
কিছু দিন আগেই কালীঘাট মন্দির চত্বরে এক নাবালিকাকে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ, তার মা-ই ভিক্ষার কাজে নামিয়েছিলেন মেয়েকে। তিনি বললেন, ‘‘মেয়েকে সরকারি হোমে রাখায় ভিক্ষার কাজে লোক কমে গিয়েছে। মাসে যা আয় হত, তা সরকার দিতে পারবে? সাহায্য চাই না, মেয়েটাকে বরং হোম থেকে ছেড়ে দিক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy