ফাইল চিত্র।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-সহ নানা কারণে বাসস্থান ভাঙা পড়লেও ওদের জন্য নেই কোনও পুনর্বাসন প্রকল্প। এক বার ঠিকানাহারা হলে তাই প্রবল সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয় পাখিদের। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তাই তারাও চেষ্টা করছে নিজেদের ঠিকানা এমন জায়গায় তৈরি করতে, যেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব কম, মানুষের নাগালেরও খানিকটা বাইরে। তাই শহরের বহু পাখিরই এখন বাসা বাঁধার জন্য পছন্দ কোনও বহুতল বা মোবাইলের টাওয়ারের মতো উঁচু জায়গা।
ঝড়ঝঞ্ঝা কিংবা নগরায়ণের কারণে অনেক দিন ধরেই বট, অশ্বত্থ, ডুমুর, আমের মতো বড় গাছ শহরের বুকে কমে যাচ্ছে। তার জেরেই কমে গিয়েছে পাখিদের বাসস্থান তৈরির জায়গা। তাই চিল কিংবা বাজের মতো শালিক, পায়রা, ঘুঘুরাও বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে মোবাইলের টাওয়ার, আকাশচুম্বী বহুতলের বারান্দা, কার্নিস কিংবা বহুতলের গা বেয়ে নামা পাইপের খাঁজের মতো জায়গায়।
২০১৯ সাল থেকে চলা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের করা একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমনই নানা তথ্য। ওই বিভাগের দাবি, এই ধরনের সমীক্ষা এখানে প্রথম। নগরায়ণের জোয়ারে যখন গাছ এবং জলাভূমি— দুইয়েরই সংখ্যা কমছে, তখন শহরের পাখিরা টিকে থাকতে কী ভাবে লড়ছে, তা নথিবদ্ধ করতে কলকাতা পুর এলাকার ৭০টি ওয়ার্ডে ওই সমীক্ষা চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘পাখি পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখাটা জরুরি। তাই এই ধরনের গবেষণার আরও প্রয়োজন। ভবিষ্যতে এমন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের কোনও প্রয়োগ বাস্তবে করা যায় কি না, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করা হবে।’’
স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপিকা মধুমিতা রায় জানান, আগামী দিনে পরিকল্পিত নগরায়ণে পাখির বাসার ব্যবস্থাও করা যায় কি না, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে সমীক্ষায়। পাশাপাশি, উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণে বিভক্ত, তিনশো বছরের পুরনো শহরে সময়ের সঙ্গে স্থাপত্যের পরিবর্তন কী ভাবে পাখিদের বাসস্থানের উপযোগী কিংবা পরিপন্থী হয়েছে, তা-ও নথিভুক্ত করা হয়েছে।
তাঁর কথায়, ‘‘পাখির বাসার জন্য প্রয়োজনীয় গাছের সংখ্যা যখন কমছে, তখন মানুষের বাড়ির মধ্যেই পাখিদের বাসা তৈরির জায়গা দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছিল। নগরায়ণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিষয়গুলির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে কী ভাবে পাখিরা বাসা বাঁধার জায়গার পরিবর্তন করছে, সমীক্ষায় সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। নির্মীয়মাণ কিংবা প্রস্তাবিত বহুতল আবাসনে কী ভাবে পাখিদের বাসার জায়গা তৈরি করা যায়, তার জন্যও রিপোর্টে পরামর্শ দেওয়া রয়েছে।’’
ওই প্রকল্পে জড়িত, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা অজন্তা দে জানান, উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়িগুলি এখনও চড়াই, ময়না, পায়রা, বুলবুলির মতো পাখিদের ভরসা। মহাত্মা গান্ধী রোডের মতো ঘিঞ্জি এলাকায় বুলবুলির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কারণ ওই সব এলাকায় প্রচুর গুদাম রয়েছে। সেখানে দেখা গিয়েছে, বাক্স-পেটি বাঁধার জন্য ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের টেপও বুলবুলি পাখি বাসা বাঁধতে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ সুতলি দড়ি, খড়কুটোর জোগান পরিবেশে কমছে। তিনি বলেন, ‘‘তথাকথিত উপাদানের বাইরে গিয়ে পাখিরা বাসা বাঁধার উপকরণও বদলে ফেলছে। বট, অশ্বত্থের মতো গাছগুলিকে হেরিটেজ ঘোষণা করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। কারণ ওই সব গাছের নীচে পুজো-পার্বণ ঘিরে পাখিদের খাবারের ভাল জোগান থাকে।’’
পক্ষীপ্রেমীদের একটি সংগঠনের সম্পাদক সুজন চট্টোপাধ্যায় এই ধরনের সমীক্ষাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে তিনি মনে করেন, বহুতলে পাখির আস্তানা তৈরি করতে হলে বাসা বাঁধার
জায়গার পাশাপাশি খাবার ও জলের মতো রসদ, ঝোপঝাড়ের মতো পরিবেশ দিতে হবে। সুজনবাবুর কথায়, ‘‘পাখি ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে পছন্দ করে। ঝোপ তৈরি করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইংল্যান্ডে গমচাষিদের ভর্তুকি দেওয়া হয়। কলকাতার পার্কগুলিতে বট-অশ্বত্থের মতো গাছ বসিয়ে পাখিদের বসবাসের পরিবেশ তৈরি করার প্রয়োজন। কারণ পাখি এসে ঘর নোংরা করলে মানুষ খুব বেশি দিন বরদাস্ত করবে বলে মনে হয় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy