Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Trucks

সেতু বাঁচাতে নিয়মে নিমরাজি, তবু ২৫ টনের লরি বইছে ৬০ টন

একের পর এক দুর্ঘটনাতেও বেপরোয়া লরির দাপট কমে না। ভোটের আগে তাদের বাড়বাড়ন্ত কিসের জোরে?

মানিকতলা কারবালা এলাকায় ট্রাকের ওজন মাপা হচ্ছে।

মানিকতলা কারবালা এলাকায় ট্রাকের ওজন মাপা হচ্ছে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:২৬
Share: Save:

শীতের রাত। কুয়াশায় ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তারাতলা মোড়ের কাছে হঠাৎ প্রাণপণে গাড়ির ব্রেক কষলেন অ্যাপ-ক্যাব চালক। সামনেই পাতি ভেঙে এক দিকে হেলে পড়ে রয়েছে লরি। বিপদ এড়াতে গার্ডরেল বসিয়ে ঘিরে দেওয়া তো দূর, অন্য গাড়ির চালককে সতর্ক করতে লরির আপৎকালীন আলো জ্বেলে রাখার নির্দেশ দেওয়ার মতো কোনও পুলিশকর্মীরও দেখা নেই।
এমন ঘটল কী করে? বেশি ওজন তুলেছেন? কয়েক মুহূর্ত আগেই দ্রুত ব্রেক কষে বিপদ এড়ানো গাড়ির চালকের প্রশ্নের জবাবে লরির চালক বললেন, ‘‘২৫ টন বইতে পারে, ৬০ টন ভরে পাঠিয়েছে। পাতি ভাঙবে না? কাউকে যে পিষে দিয়ে আসিনি, সেটাই অনেক।’’

পুলিশ ধরল না?

লরিচালকের উত্তর, ‘‘ধরলে তো মিটেই যেত। শীতের রাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হত না। গাড়ি ধরেছে বলে মালিককে ফোন করে দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। আসলে মালিকের বোঝাপড়া করা আছে। ওজনের জন্য কেউ ধরবে না!’’

ওজনের এই ফস্কা গেরোতেই শহরে একের পর এক লরি দুর্ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। কখনও বেশি ওজন নিয়ে হিমশিম খাওয়া লরি বেপরোয়া গতিতে ফুটপাতে উঠে পিষে দেয় পথচারীদের। কখনও ট্র্যাফিক সিগন্যাল ভেঙে ধাক্কা মারে উল্টো দিক থেকে আসা গাড়িকে। কখনও আবার সরাসরি ঢুকে যায় রাস্তার ধারের ঘরের দেওয়াল ভেঙে। তবু এই বাড়তি ওজন নেওয়ায় রাশ টানা যায় না। লরিচালক সংগঠনগুলির বড় অংশেরই আবার অভিযোগ, টাকার খেলায় এই বাড়তি ওজন নেওয়াই এখন কার্যত দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ওজন নেওয়ার নিয়ম পরিবর্তন করলেও রাজ্যে তা চালু হয়নি। উল্টে আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে চলছে ‘টাকায় সেটিং’-এর এক অলিখিত নিয়ম।

বেলেঘাটা চাউলপট্টির বাসিন্দা, লরিচালক সংগঠনের সদস্য নিমাই হালদারের দাবি, রাজ্যে ছ’চাকা থেকে ১২ চাকা পর্যন্ত লরির বহনক্ষমতা নির্দিষ্ট করা রয়েছে। যেমন, ছ’চাকার লরির আট টনের বেশি ওজনের সামগ্রী তোলার কথা নয়। আট চাকার লরির ক্ষেত্রে সেটি ১৬ টন। ১০ চাকা এবং ১২ চাকার লরির ক্ষেত্রে এই হিসেব যথাক্রমে ২৫ এবং ২৭ টন। কিন্তু প্রায় সব লরিই নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি সামগ্রী নিয়ে শহরে ঢুকছে বলে অভিযোগ। নিমাইবাবুর কথায়, ‘‘মাপা হলে দেখা যাবে, যার আট টন নেওয়ার কথা, সে ২৫ থেকে ৩০ টন ওজন নিয়ে শহরে ঢুকেছে। যার ২৫ টন নেওয়ার কথা, সে এনেছে ৬০ টন। ২৭ টনের লরিতে আবার চাপানো হয় ৯০ টনেরও বেশি ওজনের সামগ্রী। এমন অবস্থা হলে চালক যে সামলাতে পারবেন না সে আর আশ্চর্য কী! রাস্তা তো ঠিক থাকবেই না, সেতুও ভাঙবে।’’

‘ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য নিখিল দত্তগুপ্ত বললেন, ‘‘এমনটা হওয়ারই কথা নয়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ম বদল করেছে। লরির ভারবহন ক্ষমতা ২৫ শতাংশ করে বাড়ানো যেতে পারে বলে জানানো হয়েছে। তাতে যাতায়াতের খরচ কমায় নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দামও কমবে। কিন্তু এ রাজ্যে সেই নিয়ম চালু হয়নি। উল্টে ২৫ শতাংশের বদলে দু’-তিন গুণ বেশি ওজনের লরি ঢোকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে।’’ ওই সংগঠনেরই আর এক সদস্যের দাবি, ‘‘দেখা যায়, ভারবহনের বিধি উড়িয়ে বিপুল ওজনের নির্মাণ সামগ্রীর গাড়ি দেদার শহরে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু আলুর মতো খাদ্যপণ্যের গাড়ি আটকে দেওয়া হচ্ছে। ভেজা আলু লরিতে তুললে এমনিতেই এক টন মতো ওজন বেড়ে যায়। বাড়তি ওজন হলেই ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হয়। কিন্তু বাড়তি ওজন সংক্রান্ত মোটরযান আইনের ১১৩ এবং ১১৪ ধারার ব্যবহার অন্য ক্ষেত্রে দেখা যায় না।’’

পরিবহণ দফতরের ভারী যানবাহন সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আধিকারিক বললেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম এখানেও চালু হবে। তবে তার আগে এখানকার সেতু, উড়ালপুলগুলির অত ওজন নেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না, দেখে নেওয়া হচ্ছে। কেএমডিএ এবং পূর্ত দফতরকে সেই কাজই করতে বলা হয়েছে। এর পরে ওজন বাড়ানো যেতেই পারে।’’
কিন্তু এখন যে লরি শহরে ঢুকছে তার ভার নেওয়ার ক্ষমতা শহরের রাস্তা বা সেতুর আছে তো? উত্তর নেই কোনও তরফেই। (শেষ)

অন্য বিষয়গুলি:

Trucks Overloading
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy