—প্রতীকী চিত্র।
‘প্রণামীর বাক্স’ একাধিক। কার্যোদ্ধারে তাতে প্রণামী ঢালার বহরও আলাদা আলাদা! যেমন, যাঁর ছেলেরা নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করবেন, তিনি প্রতি বর্গফুটে প্রণামী নেবেন দেড়শো টাকা। বিধি উড়িয়ে বাড়ি তৈরির অনুমোদন পাইয়ে দেবেন যে জনপ্রতিনিধি, তাঁকে প্রণামী দিতে হবে প্রতি বর্গফুটে ৪০০ টাকা। আর সব জেনেও যাঁরা ধরপাকড় না চালিয়ে বহুতল ওঠার কাজে ‘সহায়তা’ করে যাবেন, তাঁদের প্রণামী বর্গফুটে ৩৫০ টাকা!
তবে, এই ‘প্রণামীর রেট’ও স্থির নয়। অঞ্চল বা জমি ভেদে ক্রেতার ক্ষমতা বুঝে প্রণামীও ওঠা-নামা করে! এর সঙ্গেই আছে নকশা অনুমোদন, নির্মিত বাড়ির কমপ্লিশন সার্টিফিকেট (সিসি) দেওয়া বা বেআইনি অংশ স্বল্প জরিমানায় বৈধ করার প্রণামী।
গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে ১৩ জনের মৃত্যু এবং তার দিনকয়েকের মধ্যেই উত্তর দমদমে নির্মীয়মাণ বাড়ির পাঁচিল ভেঙে এক মহিলার মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্তদন্তে এমনই তথ্য উঠে আসছে। অভিযোগ, দিনের পর দিন এ জিনিস চলতে থাকলেও পরিস্থিতির বদল হয় না। প্রশাসনিক স্তর থেকে কড়া অবস্থান নেওয়া হয় না কখনওই। বরং ঠিক ঠিক জায়গায় সময়ে প্রণামী পৌঁছে দিলেই হল। যেখানে বাড়ি একতলার বেশি উঁচু হওয়ার কথা নয়, সেখানে সহজেই পাঁচতলা উঠে যায়। জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হয় ছ’তলার চারটি টাওয়ারের ‘বিশিষ্ট’ আবাসন। দেদার দখল হয়ে যায় সরকারি রাস্তাও! কিন্তু বিষয়টি শুধু এই দুর্নীতির পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নেই। ভুক্তভোগীদের দাবি, এই প্রণামী দেওয়ার খরচ সামাল দিতেই বাড়িয়ে দেওয়া হয় ফ্ল্যাটের দাম। নির্মাণের খরচ কমিয়ে প্রণামীর বাক্স ভরতে গিয়ে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করেন প্রোমোটার। যার ফলে কোথাও বহুতল মাথায় ভেঙে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, কোথাও নির্মীয়মাণ বাড়ির অংশ মাথায় খসে পড়ে বেঘোরে প্রাণ যায়।
গার্ডেনরিচেই যেমন, ফ্ল্যাট কিনতে প্রতি বর্গফুটে দর ওঠে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা। ভেঙে পড়া বহুতলটির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটে দর ছিল দুই-আড়াই হাজার টাকা। এলাকার কংগ্রেস নেতা মহম্মদ মোক্তারের সোজাসাপ্টা অভিযোগ, ‘‘স্থানীয় নেতাদের বখশিস দিতে দিতেই তো সব শেষ। যে ধরনের সামগ্রী ব্যবহার হওয়ার কথা, তা হচ্ছে কোথায়?’’ একই অবস্থা একবালপুর, কড়েয়া, রাজাবাজার, কসবা, তিলজলা, তপসিয়াতেও। পুরসভার বিল্ডিং বিভাগ সূত্রে জানা যাচ্ছে, গার্ডেনরিচ-সহ এই সব এলাকার বেশির ভাগ বহুতলেরই ‘লাইসেন্সড বিল্ডিং সার্ভেয়ার’ (এলবিএস) দিয়ে নকশা অনুমোদন করানো নেই। ফলে দিনকয়েকের মধ্যেই ফ্ল্যাটের অবস্থাও দফারফা। যাদবপুরের এক বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘নিজের বাড়ি প্রোমোটিং করতে চাওয়ায় এক নেতা বাড়িতে এসে শর্ত দিয়ে যান, একতলায় দুটো দোকানঘর বিনামূল্যে দিতে হবে তাঁকে। প্রথমে রাজি না হওয়ায় দু’বছর কাজ করতে পারিনি। শেষে দুটো ঘর দিতে হয়েছে। সেখানে তিনি গ্যারাজের ব্যবসা করেছেন।’’ মানিকতলার এক বিধায়কের ঘনিষ্ঠ, বর্তমানে অন্য রাজনৈতিক দলে নাম লেখানো ব্যক্তি বললেন, ‘‘কোথাও নির্মাণকাজ হওয়ার কথা কানে এলেই সেখানে গিয়ে ঝামেলা পাকাতাম। পরে ঝামেলা মিটিয়ে দেওয়ার নামে দাদার কাছে নিয়ে যেতাম। দাদা প্রণামীর হিসাব বুঝে নিয়ে অনুমতি দিতেন।’’
বিধাননগর, দমদম কিংবা শহরতলির চিত্রও কিছু আলাদা নয়। বাসিন্দাদের বড় অংশেরই অভিযোগ, ছাদ মেপে টাকা ওঠে সেখানেও। প্রণামীর বদলে সুযোগ করে দেওয়া হয় জাল নকশায় কাজ করার। ওই টাকা দিতে না হলে বর্গফুট-পিছু অন্তত সাত-আটশো টাকা দাম কমতে পারত ফ্ল্যাটের। এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘ভিআইপি রোডের আশপাশে কাজের ক্ষেত্রে বর্গফুটে ৩০০-৩৫০ টাকা দিতে হয় দাদাদের। একটু দূরে পাড়ার ভিতরে প্রণামীর পরিমাণ খানিকটা কম।’’ তেঘরিয়ার এক প্রোমোটারই বলছেন, ‘‘কয়েক মাস আগে একটি কাজের জন্য সিন্ডিকেটের থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিয়েছিলাম। ঠিকঠাক দর হলে ২০-২২ লক্ষের মধ্যে হয়ে যায়। কিন্তু ৩১ লক্ষ টাকা দিতে হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, শুরুতে প্রোমোটারকে ডেকে স্থানীয় নেতা নির্দেশ দেন, এলাকার রাস্তা, নিকাশি নালা, ক্লাবের মাঠে আলো বসানোর কাজ করতে হবে। এর পরে ধীরে ধীরে নিজের প্রয়োজনীয় অঙ্কের কথা প্রোমোটারকে বলা হয়। নিউ টাউনে আবার গজিয়ে উঠেছে জমি মাপার সিন্ডিকেট। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লোক আমিনের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ, কাজ না দিলে জোটে রাতে জমির পাঁচিল ভেঙে দেওয়ার হুমকি। রয়েছে মাটি সিন্ডিকেটও। ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, কোথাও হয়তো ২০ গাড়ি মাটি প্রয়োজন। ২০টি গাড়িতে চাপিয়ে আদতে মাটি পাঠানো হয় ১০ গাড়ি। প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না।
দমদমের এক বাসিন্দার আবার অভিযোগ, ‘‘প্রশাসনের একাংশ এবং ইমারতি দ্রব্য সরবরাহকারীদের একটি বৃত্ত আছে। এক পক্ষ বেআইনি কাজের সুযোগ করে দেন, অন্য পক্ষ প্রতিদানে ভোট সামলে দেন।’’ (চলবে)
তথ্য সংগ্রহ: প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়, নীলোৎপল বিশ্বাস, কাজল গুপ্ত, চন্দন বিশ্বাস, মেহবুব কাদের চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy