Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

কতটা পিছনের দিকে হাঁটতে চাইছি আমরা?

কী পরব, কী খাব, কোথায় যাব— ইদানীং এ সব বিষয়ও স্থির করে দিচ্ছে রাষ্ট্র। মহিলাদের জন্য পোশাক-বিধির দিকটিও তাই রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

পোশাকের অজুহাতে অনেক সময়েই হেনস্থার শিকার হন মহিলারা। নিজস্ব চিত্র

পোশাকের অজুহাতে অনেক সময়েই হেনস্থার শিকার হন মহিলারা। নিজস্ব চিত্র

অন্বেষা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৯ ০১:৫৯
Share: Save:

শৌচাগারের পাইপ থেকে জল পড়ছিল। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীটি তাই নিয়ে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন আবাসন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কাছে। পরনে ছিল টি-শার্ট ও শর্টস। অভিযোগ, তরুণীর এই পোশাক ‘শালীন’ নয়, এই যুক্তিতে তাঁকে সাহায্য করতে চাননি ওই সভাপতি। গত জুলাইয়ে কালিকাপুর মোড়ের এই ঘটনায় সভাপতির বিরুদ্ধে পুলিশে যান ওই তরুণী।

চলতি মাসে লর্ডসের মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ফিলের ছাত্রী। পরনে টি-শার্ট এবং শর্টস। পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সি এক মহিলা তাঁকে বলেন— ‘‘তোমাদের মতো মেয়েরাই ধর্ষিতা হয়।’’ অভিযোগ, এ কথার প্রতিবাদ করলে তরুণীকে সটান চড় মারেন ওই মহিলা!

সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছিল দিল্লির একটি ভিডিয়ো। সেখানে মাঝবয়সি এক মহিলা রেস্তরাঁয় আসা কয়েক জন মিনি স্কার্ট পরা মেয়েকে বলেছিলেন, ‘‘এত ছোট পোশাক পরে এসেছ, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত।’’ এমনকি, রেস্তরাঁয় থাকা পুরুষদেরও তিনি পরামর্শ দেন, ‘‘ছোট পোশাক পরা এই ধরনের মেয়ে সামনে পেলেই আপনাদের উচিত ধর্ষণ করা।’’ ওই মহিলাকে পরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন ওই মেয়েরা।

অতীতের দিকে ফিরে তাকালে এমন ঘটনার নজির আরও মিলবে। ৭৩তম স্বাধীনতা দিবসে পৌঁছে তাই প্রশ্ন উঠছে, মেয়েদের পোশাকে বিধিনিষেধ আরোপ করে কতটা পিছনের দিকে হাঁটতে চাইছি আমরা? পোশাকের সঙ্গে ধর্ষণের হুমকি আমাদের কোন মানসিকতাকে তুলে ধরছে?

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমাদের মানসিকতাতেই রয়েছে সংশোধনী-ধর্ষণ, যা আসে নীতি-পুলিশি থেকে। পিতৃতন্ত্র আমাদের মধ্যে এই মনোভাব এতটাই আত্মস্থ করিয়েছে যে, একটি মেয়ে আর একটি মেয়েকেও দেখে পুরুষের চোখ দিয়েই। ধর্ষণ সেখানে শাস্তি, অর্থাৎ সংশোধনের উপায়। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতায় ভয়। যা মেয়েদের বোঝায়, স্বাধীন ভাবে বাঁচার অনেক হ্যাপা। বোঝায়, স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বের সম্পর্ক, যা থেকে দূরে থাকাই মেয়েদের পক্ষে সুবিধাজনক।’’

কী পরব, কী খাব, কোথায় যাব— ইদানীং এ সব বিষয়ও স্থির করে দিচ্ছে রাষ্ট্র। মহিলাদের জন্য পোশাক-বিধির দিকটিও তাই রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু ‘শহুরে শিক্ষিত নাগরিক’ হয়ে আমরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারছি না কেন? অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ধর্ষণ একটা অপরাধ। তার সঙ্গে আর কিছু টানার অর্থ নেই। পোশাকের তুলনা তো নয়ই। ধর্ষণের পিছনে যুক্তি হিসেবে যেটা হামেশাই এসে থাকে।’’

কখনও বোরখা বা হিজাব, কখনও ঘোমটা বা ওড়না— নানাবিধ ‘শোভন’ পোশাকে মহিলাদের আবৃত রাখার উপায় অবশ্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বহু দিন ধরেই প্রচলিত। শর্টস বা হট প্যান্ট তো হালফিলের সমস্যা। পা-ঢাকা জিন্‌সও এখনও পর্যন্ত ‘শালীন’ পোশাকের তকমা কুড়োতে পারেনি।

গত জুনে নৈহাটিতে বছর উনিশের এক তরুণী পোশাক নিয়ে শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। এমন ঘটনা ঘটলে অনেক সময়েই বলে দেওয়া হয়, মেয়েটির ধৈর্য কম, তাই অল্পে হেরে গিয়েছে। কিন্তু ক’জন ছেলেকে বলা হয়, ‘তোমার বিয়ে হয়েছে, আর হাফ প্যান্টে বাজারে যেও না’! কিছু ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ির হস্তক্ষেপের বহু আগেই এ যুগের প্রেমিক-পুরুষ তাঁর প্রেমিকাকে বুঝিয়ে দেন, ‘বিয়ের পরে বন্ধ ঘরে যা খুশি পরে দেখাতে পারো। কিন্তু বাইরে শুধুই শালীন পোশাক পরতে হবে।’

আর বিধিবদ্ধ সেই পোশাক অঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ যখন আটকায় না?

তখন সহজেই আঙুল তোলা যায় মেয়েটির চরিত্রের দিকে। যেন তেন প্রকারে বোঝানোর চেষ্টা হয় যে সব দোষ মেয়েটিরই, তা তাঁর পরনে শর্টস থাকুক কিংবা শাড়ি। মাতৃস্থানীয়ার সপাট চড় তাই অক্লেশে চেপে বসে অপরিচিতা তরুণীর গালে।

যে চড় বুঝিয়ে দেয়, আমি যা পারিনি, তুমিও তা পারবে না। স্বাধীনতার প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়েও না।

অন্য বিষয়গুলি:

Sexual Harassment Molestation Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy