Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Debanjan Das

স্বপ্নপূরণে ঘরকুনো ছেলে থেকে ‘আইএএস’

দেবাঞ্জনের অফিস, বাড়ি এবং লালবাজার সূত্রে উঠে এসেছে এমন সব তথ্যই।

 নিজের অফিসে  ওই যুবক। ছবি: সংগৃহীত

নিজের অফিসে ওই যুবক। ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২১ ০৬:২৮
Share: Save:

পাড়ায় তার পরিচিতি ছিল ঘরকুনো ছেলে হিসেবে। কিন্তু মনের মতো চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টাই শুধু নয়, সেই চরিত্রে বাঁচতে গিয়ে ধূমকেতুর মতো উত্থান ভুয়ো প্রতিষেধক-কাণ্ডে ধৃত দেবাঞ্জন দেবের। সেই সূত্রেই মনে মনে রাতারাতি তার ‘আইএএস অফিসার’ হয়ে ওঠা। এমনকি, ব্যাট-বল হাতে মাঠে যাওয়া ছেড়ে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ‘অফিস’ যাওয়াও! বাবার গাড়ির বদলে রাতারাতি নীল বাতি লাগানো এসইউভি!

দেবাঞ্জনের অফিস, বাড়ি এবং লালবাজার সূত্রে উঠে এসেছে এমন সব তথ্যই। শুক্রবার কসবায় দেবাঞ্জনের অফিসে গিয়ে দেখা গেল, চারতলা বাড়ির তিনতলায় ফ্ল্যাট নিয়ে কার্যত সমান্তরাল পুরসভা বানিয়েছে সে। কোল্যাপসিবল গেট পেরিয়ে দরজায় সাঁটা আটটি সার্কুলার। সব ক’টিই পুরসভার নামে। কোনও সার্কুলারে তার অফিসের কর্মীদের কাজে যোগ দিতে বলা হচ্ছে, কোনওটিতে আবার নোটিস দিয়ে জানানো হচ্ছে কাজের নিয়ম। একটি সার্কুলারে আবার পুরসভার যুগ্ম কমিশনার হিসেবে সইও রয়েছে দেবাঞ্জনের!

সূত্রের খবর, এই অফিস পর্যন্ত দেবাঞ্জনের উত্থান সিনেমাকেও হার মানায়। আনন্দপুরে দেবাঞ্জনের তিনতলা বাড়ির প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, ওই যুবকের বাবা মনোরঞ্জন দেব ছিলেন ডেপুটি এক্সাইজ কালেক্টর। তিনি চাইতেন, ছেলে আইএএস অথবা আইপিএস হোক। শিয়ালদহের টাকি স্কুলের ছাত্র দেবাঞ্জন প্রাণিবিদ্যা নিয়ে চারুচন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়। এর পরে জেনেটিক্সের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সে পড়া শেষ করতে পারেনি। কলেজের পরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সেখানেও মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়। মাঝে একটি ফুটবল ক্লাবও কিনবে বলে ঠিক করেছিল ওই যুবক। দেবাঞ্জনের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘ছেলেটি কখনওই লেখাপড়ায় ভাল ছিল না। তবে আঁকত ভাল। স্কুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। গানের গলাও ভাল ছিল। পরে শুনলাম, সেই ছেলেই রাতারাতি আইএএস হয়ে গিয়েছে।’’

স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে দেবাঞ্জন দেব (চিহ্নিত)। । ছবি: সংগৃহীত

স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে দেবাঞ্জন দেব (চিহ্নিত)। । ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বেলেঘাটার একটি কেন্দ্রে দেবাঞ্জনের সিট পড়েছিল। সেই বারের প্রিলিমিনারি এবং মেন, দুটোতেই পাশ করে গিয়েছে বলে সে বাড়িতে জানিয়েছিল। এর পরে দেবাঞ্জন তার মা-বাবাকে জানায়, ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্রশিক্ষণের জন্য সে বাইরে থাকবে। সূত্রের খবর, ওই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল সে। তখনই তার কয়েকটি গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। বাড়িতে দেবাঞ্জন আরও জানিয়েছিল, চলচ্চিত্র উৎসবে সে চিত্র পরিচালক হিসেবে ডাক পেয়েছে। ২০১৭-য় সে বাড়ি ফিরে জানায়, তার আইএএস-এর প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। পোস্টিং হয়েছে নবান্নে।

গত বছর করোনার প্রথম ধাক্কার সময়ে দেবাঞ্জন ঠিক করে, সে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার বিক্রির ব্যবসা করবে। এর জন্য তালতলায় কয়েকটি ক্লাবঘর সে গুদাম হিসেবে ভাড়া নেয়। লোক নিয়োগ করে চড়া দামে মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার, পিপিই বিক্রি করতে শুরু করে। এর পরে বেশ কিছু জায়গায় সামাজিক কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে বিনামূল্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার বিলিও করে ওই যুবক। তা করতে গিয়ে দেবাঞ্জনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে রাজনৈতিক নেতা, থানা ও প্রশাসনের বড়কর্তাদের। বিনামূল্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার দিতে গিয়ে পাওয়া ‘সম্মানের মোহ’ তাকে ঘিরে ধরে বলে পুলিশের অনুমান। ফলে, দ্বিতীয় দফার করোনার আগে সে হয়ে ওঠে পুরোদস্তুর ‘সমাজসেবী’। এর মধ্যেই তার যোগাযোগ তৈরি হয় পুর মহলে। ‘আর্বান প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি ভুয়ো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি করে সে। পুরসভার ঠিকাদারদের সঙ্গে পরিচয় করে সাব-কনট্র্যাক্টর হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। সেই সূত্রে বেহালার এক জনের থেকে দেবাঞ্জন ১০ লক্ষ টাকা নিয়েছিল বলেও অভিযোগ।

জানা গিয়েছে, প্রতিষেধক নিয়ে হাহাকার শুরু হতে এই ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করার পরিকল্পনা করে ওই যুবক। যা সে শুরু করেছিল নিজের সংস্থার কর্মীদের আগে প্রতিষেধক দিয়ে। নিজের প্রভাব এবং ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে সেই সময়েই নীল বাতি লাগানো গাড়ি ভাড়া করে সে, রাখে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী। দেবাঞ্জনের এক প্রতিবেশী রিনা মাইতি বলেন, ‘‘আনন্দপুরে ওঁদের বাড়ির জমিটা আমাদের থেকেই কিনেছিলেন দেবাঞ্জনের বাবা। দেখতাম, ছেলেকে সর্বক্ষণ মাথায় তুলে রাখতেন তাঁরা। কী জানি, বাবার স্বপ্ন পূরণের চাপই ওকে এই পথে নিয়ে গেল কি না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Debanjan Das
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE