অঘটন: গার্স্টিন প্রেসের সেই বাড়িতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন দমকলকর্মীরা। এই বাড়ির পাশেই রয়েছে সেই জন’স গির্জা ও জোব চার্নকের সমাধি। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।
কখনও সমাধিক্ষেত্র। কখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলা-বারুদ রাখার জায়গা। শুধুমাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজনের জন্য কলকাতার প্রথম হাসপাতাল তৈরি এখানেই! কখনও আবার ইংরেজ স্থপতি তথা ‘টাউন হল’-এর নির্মাতা জন গার্স্টিন এখানেই তৈরি করিয়েছেন পাঁচটি বাড়ি। ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত সেই পাঁচটি বাড়িই পরে হয়ে ওঠে গার্স্টিন প্লেস! কলকাতায় সেই পাঁচটি বাড়ির এক নম্বর বাড়ি থেকেই পথ চলা শুরু হয়েছিল ভারতীয় বেতারের।
কালের নিয়মে বাড়িগুলির ভোলবদল হয়েছে। বেতার সম্প্রচার সরেছে ময়দানের আকাশবাণী ভবনে। পুরনো ভবনটি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য নতুন রূপ পেয়েছে। তবু কোনও মতে দাঁড়িয়ে থাকা গার্স্টিন লেনের চার ও পাঁচ নম্বর বাড়ির একটিতেই আগুন লাগে শনিবার। যা নিয়ে শহর কলকাতার গবেষক থেকে নাগরিকদের অনেকেই বলছেন, ‘‘শুধু ইতিহাসটাই রয়ে গিয়েছে। সেই গার্স্টিন লেন আর নেই। অগ্নিকাণ্ডের পরে এ বার হয়তো বাড়িটিও অস্তিত্ব হারাবে।’’
আশির দশক থেকে বেতারের সঙ্গে যুক্ত ভবেশ দাস বলেন, ‘‘আগুনের খবর শুনে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কোন বাড়িটায় আগুন লেগেছে। বেতারের সূত্রেই গার্স্টিন প্লেস নিয়ে আলাদা আবেগ রয়েছে।’’ তিনি আরও জানান, ১৯২৭ সালের ২৬ অগস্ট গার্স্টিন প্লেসের এক নম্বর বাড়িতে বেতার সম্প্রচারের প্রথম দিন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লবালা, সিতাংশু মজুমদারেরা ছিলেন। গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপস্থিতিতে প্রথম সম্প্রচার হয়। ওই ভবনের দু’টি তল ভাড়ায় নেওয়া ছিল। নীচের তলায় মদের ব্যবসা চললেও পরে মালিক তা সরিয়ে নেন। ১৯৫৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আকাশবাণী ভবনে সবটা সরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত জওহরলাল নেহরু থেকে বল্লভভাই পটেল-সহ অনেকেই এখানে এসেছেন। তার সঙ্গে ছিল গার্স্টিন প্লেসের ভূতের গল্প!
কলকাতা গবেষক হরিপদ ভৌমিক আবার জানালেন ওই এলাকার হেরিটেজ গুরুত্বের কথা। যে ভবনে এ দিন আগুন লেগেছে, তার পাশেই সেন্ট জন’স গির্জা। বয়সের দিক থেকে বড়বাজারের আর্মানি গির্জা বা মিশন রো-এর ওল্ড মিশন গির্জার পরেই রয়েছে এই গির্জাটি। এক সময়ে ব্রিটিশ সেনার ছাউনি হিসাবে ব্যবহৃত এই এলাকায় ১৭০৭ সাল নাগাদ তৈরি হয় হাসপাতাল। ১৭৫৬ সাল নাগাদ সিরাজউদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণের সময়ে হাসপাতালটি চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত তার অস্তিত্ব টিকে ছিল। পরে এখানেই ওয়ারেন হেস্টিংস গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জমি দেন শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব। ১৭৮৭ সালে সাধারণের জন্য খোলা হয় গির্জা। লোকে ডাকত পাথুরে গির্জা বলে। সেই পাথর নাকি গৌড়, অর্থাৎ মালদহ থেকে আনা হয়। এখানেই রয়েছে একদা ছোটলাট লর্ড ব্রেবোর্নের সৌধ, আঠারো শতকে রোহিলা যুদ্ধে নিহত কোম্পানির সেনানীদের স্মারক, প্রথম বড় লাটের স্ত্রী লেডি ক্যানিং এবং কলকাতার বিতর্কিত ‘প্রতিষ্ঠাতা’ জোব চার্নকের সমাধি। হরিপদবলেন, ‘‘আঠারো শতকের মাঝামাঝি অবধি এই চত্বরে ছিল কলকাতায় সাহেবদের সমাধিক্ষেত্র। সেই সঙ্গে হাসপাতালে তখনকার করুণ জীবন আর গার্স্টিন সাহেবের তৈরি ভবনের পুরনো দশার জেরে ভূতের গল্প রটেছিল। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও গার্স্টিন প্লেসের ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এখানকার বেতার অফিসের পিয়ানো বাজা ঘিরে যে কত গল্প আছে!’’
তবে ইতিহাসে মন নেই সেন্ট জন’স চার্চের নিরাপত্তাকর্মী মহম্মদ হারুনের। দমকলকর্মীরা তখন জোব চার্নকের সমাধির উপর দিয়েই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। হারুন বলেন, ‘‘পোড়া বাড়িটি ভেঙে পড়লে তো চার্নকের সমাধির উপরেই পড়বে। সেই চিন্তায় ঘুম উড়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy