কলকাতা শহরেও দীর্ঘ সময় থেকে গিয়েছেন শেক্সপিয়রের রক্তের সম্পর্কের স্বজন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘সনেট’ শব্দটা কোথাও একবার উচ্চারিত হলেই, স্ট্র্যাটফোর্ড আপঅন অ্যাভন , নিয়তি-তাড়িত প্রেম ইত্যাদির কথা মনে উদয় হলেই যাঁর নাম সর্বাগ্রে মনে আসে, তিনি উইলিয়াম শেক্সপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ)। আজ, তাঁর মৃত্যুর চারশো বছর পরেও আমরা ‘টু বি অর নট টু বি’ অথবা ‘দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ’-জাতীয় বাক্যকে আমাদের বাকধারার অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করে চলেছি। যাঁর লেখা নাটক আজ, এত দিন পরেও সমান জনপ্রিয়, ব্রডওয়ে থেকে হলিউড, এমনকি সুদূর জাপান থেকে আমাদের বলিঊড পর্যন্ত যে প্রতিভাবানের কাছে বার বার ছুটে যায়, সেই শেক্সপিয়রের পরিবারের সঙ্গে ভারতের একটা যোগ রয়েছে, এ কথা আমরা অনেকেই জানি না। শেক্সপিয়র পরিবারের একটি শাখা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতে চলে এসেছিল এবং কোম্পানির প্রশাসন, সেনাবাহিনী ইত্যাদির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল, এ খবর আমরা, ভারতীয়রা অনেকেই রাখি না। হ্যাঁ, আমাদের গল্প সেই ভারতের ‘শেক্সপিয়র’ পরিবারকে নিয়েই।
কবি-নাট্যকার উইলিয়ম শেক্সপিয়রের পিতামহ রিচার্ড এবং পিতামহী অ্যাবিগেলের পাঁচ সন্তান— হেনরিয়ে, অ্যানা, জন, টমাস এবং ম্যাথ্যু। এঁদের মধ্যে জন শেক্সপিয়র এবং তাঁর স্ত্রী মেরিই হলেন আমাদের একান্ত পরিচিত ‘বার্ড অব অ্যাভন’ উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বাবা-মা। জনের ছোট ভাই ম্যাথ্যু, মানে মনীষী শেক্সপিয়রের আপন ছোটকাকার ছেলে টমাস এবং তাঁর বংশধররা পরিচিত ছিলেন ‘শ্যাডওয়েল শেক্সপিয়র’ নামে। এঁরা লন্ডনের শ্যাডওয়েলের বাসিন্দা ছিলেন। দড়ি তৈরির ব্যবসায় এঁরা বেশ প্রতিষ্ঠা পান। এঁরা এঁদের পদবির শেষ প্রান্তে অবস্থানরত ‘ই’ অক্ষরটি বর্জন করেন এবং এঁদের পদবি দাঁড়ায় ‘Shakespear’।
শেক্সপিয়র পরিবারের প্রায় প্রতিটি প্রজন্মের পুরুষদের নামকরণের ব্যাপারে এক অদ্ভুত রক্ষণশীলতা দেখা যায়। জন, ম্যাথ্যু, উইলিয়ম আর টমাস— এই নাম ক’টি ঘুরে ফিরে আসে প্রায় প্রতিটি প্রজন্মেই। নাট্যকার শেক্সপিয়রের ছোটকাকা ম্যাথ্যুর ছেলে টমাসের নাতির নাতি জন শেক্সপিয়র (১৭৪৯-১৮২৫ খ্রিঃ) ছিলেন বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের একান্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁর সূত্র ধরেই ভারতে শেক্সপিয়র-বংশধরদের আগমন ঘটে। এই জন শেক্সপিয়র পলাশির যুদ্ধের এক দশক পরে ভারতে কোম্পানির 'রাইটার' হিসাবে কাজ করতে আসেন ও ১৭৭৮ সালে, মাত্ৰ ঊনত্রিশ বছর বয়সে, ঢাকায় কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৭৮০ খৃস্টাব্দে বিপুল ধন-সম্পদ সঞ্চয় করে তিনি লন্ডন ফিরে যান।
ব্রিটিশ লাইব্রেরির ‘আনটোল্ড লাইভস ব্লগ’-এ ইন্ডিয়া অফিস প্রাইভেট পেপার্স-এর কিউরেটর শিয়াও ওয়েই বন্ড লিখেছেন— “ফারসি ও আরবি সাহিত্যের খ্যাতনামা শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক ড. ওমর পাউন্ড ( ১৯২৬-২০১০), যিনি মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড ও তাঁর ইংরেজ পত্নী ডরোথি শেক্সপিয়রের একমাত্র পুত্র, তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর যাবতীয় পারিবারিক পুঁথি-পত্র, পাণ্ডুলিপি, চিঠি ইত্যাদি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে দান করে গিয়েছেন।” প্রসঙ্গত, এজরা এবং ডরোথির প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ডরোথির মা অলিভিয়া শেক্সপিয়রের (১৮৬৩-১৯৩৮) সালোঁতে। এই অলিভিয়া আবার ছিলেন কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের এক সময়কার প্রেমিকা। তিনি নিজেও উপন্যাস লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। সেই সঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতির সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও অলিভিয়ার খ্যাতি ছিল। কেনসিংটনে তাঁর সালোঁতে এজরা পাউণ্ড, টি এস এলিয়ট এবং জেমস জয়েসের মতো লেখকরা নিয়মিত যেতেন।
জন শেক্সপিয়র। ছবি সৌজন্য:উইকিমিডিয়া কমনস।
কিউরেটর বন্ড আরও লিখেছেন, “শেক্সপিয়র পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব ব্রিটিশ ভারতের সারস্বত ও সামরিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এঁদের মধ্যে সাহিত্যিক উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে, জেনারেল স্যর জন লো, কর্নেল রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়র উল্লেখযোগ্য। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নামের সঙ্গে যাতে কোনও বিভ্রান্তি না ঘটে, সেই কারণে ব্রিটিশ ভারতের শেক্সপিয়ররা নিজেদের পদবীর অন্তিমে থাকা ‘ই’ অক্ষরটি বাদ দেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, এঁদের অন্যতম পূর্বপুরুষ ছিলেন শ্যাডওয়েলের জন শেক্সপিয়র, যিনি কিনা স্ট্র্যাটফোর্ডের কবির সঙ্গে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ।”
রাজপুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চক্রান্ত আর সমুদ্র-অ্যাডভেঞ্চার
জন শেক্সপিয়র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে এক জুনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু ১৭৭৮ সালের মধ্যেই তিনি কোম্পানির ঢাকা অফিসের চিফ অব দ্য কাউন্সিল হয়ে দাঁড়ান। সেই সময় তাঁর বয়স মাত্র ২৯। ১৭৮০ সালে জন ভারত ছাড়েন। তত দিনে তিনি বিপুল ধন-সম্পদের মালিক। তাঁর দেশে ফেরার ঘটনা এক অতি রোমাঞ্চকর কাহিনি । এর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও চক্রান্তের এক শ্বাসরুদ্ধকারী ইতিবৃত্ত।
ইংল্যান্ডের ফেরার আগে জনকে একটি গোপন চিঠি পাঠান বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। জনের দায়িত্ব ছিল এই চিঠি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের চেয়ারম্যান লরেন্স সুলিভ্যানের হাতে পৌঁছে দেওয়া। এই চিঠিতে তৎকালীন ভারতে, বিশেষত বাংলায়, বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে যে এক্তিয়ার সংক্রান্ত সমস্যার বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলছিল তার সমাধান সম্পর্কে হেস্টিংস তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন ।
সেই সময়ে হেস্টিংসের প্রতিদ্বন্দ্বী আইরিশ বংশোদ্ভূত হুইগ রাজনীতিবিদ স্যর ফিলিপ ফ্রান্সিস বেশ অসুস্থ, হেস্টিংসের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত ডুয়েলের অভিঘাত তিনি তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এক্তিয়ার-বিতর্কে তিনি স্বভাবতই হেস্টিংসের থেকে ভিন্ন মত পোষণ করছিলেন। ফ্রান্সিসের সঙ্গেগ হেস্টিংসের শত্রুতা বেশ জটিল আকার নিচ্ছিল সেই সময়।
যে নৌবহরের জাহাজে জন শেক্সপিয়র ইংল্যান্ড ফিরছিলেন, সেই বহরেরই আর একটি জাহাজে ফিলিপ ফ্রান্সিসও ছিলেন। হেস্টিংসের চিঠি কোম্পানির বড়কর্তাদের হাতে পৌঁছনোর আগেই তিনি দেশে ফিরে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের সামনে আওয়াজ তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ফ্রান্সিসের এই অভিসন্ধির কথা জানতে পারেন জন। এবং তিনি দক্ষিণ অতলান্তিকের ব্রিটিশ দ্বীপ সেন্ট হেলেনায় বহর পৌঁছতেই নিজের জাহাজ থেকে নেমে এক ওলন্দাজ জাহাজে ঊঠে পড়েন। ওলন্দাজ জাহাজটি সেই মুহূর্তেই সেন্ট হেলেনার বন্দর ছেড়ে ইংল্যান্ড অভিমুখে রওনা দিচ্ছিল।
ফিলিপ ফ্রান্সিসের চার মাস আগে জন শেক্সপিয়র ইংল্যান্ড পৌঁছন। জন আর ফান্সিসের এই সমুদ্রযাত্রা ও অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি পাওয়া যাবে উরসুলা লো-র লেখা ‘ফিফটি ইয়ার্স উইথ জন কোম্পানি’ গ্রন্থে। এই বই প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। উরসুলা ভারতের শেক্সপিয়রদের আত্মীয় ছিলেন। প্রসঙ্গত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই সময়ে ‘জন কম্পানি’ নামেও পরিচিত ছিল। ভারতীয় ভাষায় অনেক সময়েই লেখা হত—‘জান কোম্পানি’।
আলিপুরের বাগানে সস্ত্রীক ওয়ারেন হেস্টিংস। ছবি সৌজন্য:উইকিমিডিয়া কমনস।
স্যর ফিলিপ ফ্রান্সিসের অভিযোগে ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পদের অপব্যবহার ও তহবিল আত্মসাতের ইমপিচমেন্ট মামলা শুরু হয়। যদিও হেস্টিংস এই মামলা জিতে যান, কিন্তু তাতে তাঁর এতই পয়সা খরচ হয় যে উনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে, মামলা না লড়ে দোষ স্বীকার করলে তিনি বুদ্ধিমানের কাজ করতেন। যাই হোক, হেস্টিংস যখন ইংল্যান্ডে ফেরেন উনি জন শেক্সপিয়রকে তাঁর পরিবারের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক উইলিয়াম শেক্সপিয়রের একটি মূর্তি উপহার দেন, যা বহুকাল এঁদের পরিবারের গর্বের বস্তু ছিল।
অন্ধকারের আগন্তুক
জন শেক্সপিয়র আর ওয়ারেন হেস্টিংসকে নিয়ে আরও একটি রোমাঞ্চকাহিনি বিদ্যমান। এই গল্পটি একটু বেশি মাত্রায় শেক্সপিয়রীয়। এতে এক পিতার বিদেহী আত্মার প্রসঙ্গ রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ ভাবে ‘হ্যামলেট’-কে মনে পড়ায়।
এই ঘটনা জন শেক্সপিয়রের কলকাতা ত্যাগের ঠিক আগেকার। একদিন বিকেলে ওয়ারেন হেস্টিংসের দফতরে সবাই কাজে ব্যস্ত। অফিস বন্ধ হয় হয়, এমন একটা সময়। হঠাৎই সেই অফিসের নীরবতা ভেঙে গেল জনের আর্ত চিৎকারে। “হে ভগবান! এ তো আমার বাবা!” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন জন। গভর্নর জেনারেল সমেত ঘরে উপস্থিত সকলে চমকে তাকালেন। আর তাঁরা প্রত্যেকেই নাকি দেখতে পেয়েছিলেন, এক বয়স্ক ব্যক্তি প্রায় হাওয়ায় ভেসে সেই ঘর থেকে জানলা দিয়ে গলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। হেস্টিংসের ব্যক্তিগত সচিব জোসেফ ক্যাটর পরে এই ঘটনার কথা লিখেছিলেন। ক্যাটরের বিবরণ অনুযায়ী, সেই বয়স্ক ব্যক্তি এক আজব রকমের টুপি পরেছিলেন। ভারতে সে রকম টুপি সেই সময়ে সাহেবরাও দেখেননি। কেমন একটা ‘চিমনি পট’-এর মতো দেখতে ছিল সেই টুপি, অনেকটা টপ হ্যাট আর বোলার হ্যাটের মিশ্রণ যেন সেটি।
সেই ব্যক্তির অবয়ব যখন ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, সমবেত হতচকিতদের মধ্যে সবার আগে সম্বিৎ ফিরে পেলেন হেস্টিংসই। তিনি নির্দেশ দিলেন, এই ঘটনার একটা অফিসিয়াল রেকর্ড যেন লিখে রাখা হয়। তাঁর সেই নির্দেশ পালিত হয়। সে দিন সামান্য কিছু কাজ সেরে দফতরের কর্মীরা বেরিয়ে আসেন।
কয়েক সপ্তাহ পরে কলকাতায় আগত এক জাহাজ এক দুঃসংবাদ বয়ে আনে— জন শেক্সপিয়রের বাবা প্রয়াত হয়েছেন। এই জাহাজেই এসেছিল সেই সময় ইংল্যান্ডে চালু হওয়া নতুন ফ্যাশনের টুপি—‘চিমনি পট হ্যাট’। হেস্টিংসের আদেশে লিখিত রেকর্ড অবশ্য পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে, প্রায় এক শতাব্দী বাদে, বিংশ শতকের গোড়ায় ইংল্যান্ডে শেক্সপিয়র এবং ক্যাটর পরিবারের সদস্যরা আলাদা আলাদা করে তাঁদের পারিবারিক বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেন, যেখানে এই কাহিনিটি খুঁজে পাওয়া যায়।
কোম্পানির তরুণ তুর্কি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে থাকাকালীনই জন শেক্সপিয়রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে সিনিয়র (‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর লেখক থ্যাকারে সাহেবের ঠাকুর্দা) এবং ম্যাড্রাস আর্মির রবার্ট লো-এর। এই বন্ধুত্ব পরে পারিবারিক সখ্যে পরিণত হয় এবং এই বন্ধন প্রায় ২০০ বছর তিন পরিবারের মধ্যে বজায় ছিল।
ডরোথি শেক্সপিয়র পাউন্ড, কবি এজরা পাউন্ডের স্ত্রী। ছবি সৌজন্য:উইকিমিডিয়া কমনস।
পরে শেক্সপিয়র, থ্যাকারে এবং লো পরিবারের মধ্যে বিবাহ সূত্রে আত্মীয়তাও ঘটে। সামরিক এবং সামাজিক কাজকর্মেও তিন পরিবার কাছাকাছি আসে বার বার। এই তিন পরিবারের সদস্যদের অনেকেই ইম্পিরিয়াল অথবা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস-এ যোগ দেন, অনেকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কাজ নেন, আবার অনেকে আইনজ্ঞ, সাংবাদিক অথবা লেখকের বৃত্তিও গ্রহণ করেন। এই তিন বিখ্যাত পরিবারের মেলামেশা নিয়ে জনসমাজে কৌতূহল ছিল যথেষ্ট। সেই কারণে এই তিন পরিবারের অনেক সদস্যই বেশ কিছু বই লিখে যান।
জন শেক্সপিয়রের ছেলে জন ট্যালবট শেক্সপিয়র, উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে সিনিয়রের মেয়ে এমিলি থ্যাকারেকে বিয়ে করেন। এমিলি আবার সাহিত্যিক থ্যাকারের পিসি। ১৮০৩ সালের মার্চ মাসে শেক্সপিয়র-থ্যাকারে পরিবাবারের এই বিয়ে হয় কলকাতার সেন্ট জন’স চার্চে। সেই সময় জন ট্যালবট বীরভূমের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর। ট্যালবট ও এমিলির ন’টি সন্তান হয়। তাঁদের মধ্যে তিন পুত্র ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দেন (ঘটনাচক্রে তাঁদের একজনের নাম ছিল উইলিয়াম মেকপিস। কিন্তু তিনি ছিলেন উইলিয়াম মেকপিস শেক্সপিয়র)।
এই দম্পতির আর এক ছেলে ছিলেন জর্জ ট্রেন্ট। তিনি সেনাবাহিনীতে বা সিভিল সার্ভিসে যাননি, কিন্তু এক অদ্ভুত কারণে তিনি বিখ্যাত হন। তাঁকে ‘রলি পলি জর্জ’ বলে ডাকা হতো। এমন নামকরণের পিছনে যে কারণ ছিল তা এই— জর্জ ছিলেন বিপুলায়তন মানুষ, তাঁকে ‘পোলার বিয়ার’ বা ‘শ্বেত ভল্লুক’ বলে ডাকা হত। তার উপরে তাঁর হাঁটাচলাও ছিল মন্থর, ঢিলেঢালা। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য টিয়ার্স অফ দ্য রাজাস: মিউটিনি, মানি অ্যান্ড ম্যারেজ ইন ইন্ডিয়া, ১৮০৫-১৯০৫’ গ্রন্থে ফার্ডিন্যান্ড মাউন্ট লিখেছেন, “ উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে জুনিয়রের ধ্রুপদী রচনা ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর স্থূলকায়, অলস এবং অতিরিক্ত সাজগোজ-প্রিয় চরিত্র জো সেডলি আসলে জর্জ ট্রেন্ট শেক্সপিয়রের এক অতিরঞ্জিত বর্ণনা।” জর্জ-ট্রেন্ট কোনও দিন খুব একটা কাজকর্ম করেননি। তিনি ১৮৪৪ সালে ৩৪ বছর বয়সে জেনেভায় আত্মহত্যা করেন।
জন ট্যালবট এবং এমিলির কন্যা অগস্টা তাঁর পিতামহ জন শেক্সপিয়রের বন্ধু রবার্ট লো-এর বংশধর স্যার জন লো-কে বিয়ে করেন। জন লো সেই সময় লখনউয়ের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট। আর সেই সময়ে লখনউয়ে রাজনৈতিক গোলযোগ শুরু হয়েছে। সেই দিন বদলের পালা এবং সেখানে জন লো-র উপস্থিতি ও ভূমিকার কথা বিস্তারিত লিখেছেন ফার্ডিন্যান্ড মাউন্ট তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থে।
শেক্সপিয়র আর থ্যাকারে— দুই পরিবার কাছাকাছিই থাকত। কলকাতার আলিপুর রোডের দুই ভিলায় ছিল তাঁদের বাস। এমিলি আবার তাঁর আবাসে নিয়মিত পার্টি দিতেন, যেখানে সেই সময়কার কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রায় সব্বাই আমন্ত্রিত হতেন।
সাহিত্যিক উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে জুনিয়র। ছবি সৌজন্য:উইকিমিডিয়া কমনস।
আলিপুরেই সাহিত্যিক উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে জুনিয়র জন্মান। তাঁর বাবা এমিলির ভাই রিচমন্ড থ্যাকারে এবং মা অ্যানি বেচার। রিচমন্ড ছিলেন ২৪ পরগনার কালেক্টর। ১৮২৪ সালে এমিলি শেক্সপিয়র কলকাতাতেই কলেরায় মারা যান। তাঁর বয়স তখন ৪৪। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটারিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্বামী জন ট্যালবট মারা যান ১৮২৫ সালে। তিনি মারা গিয়েছিলেন জাহাজে। তাঁকে সলিল সমাধি দেওয়া হয়। কিন্তু, এমিলির কবরের ঠিক পাশটিতে জনের একটা স্মারক স্থাপন করা হয়। আজও এই সমাধি ও স্মারক বিদ্যমান।
বিখ্যাত পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক ১৯৭৫ সালে উইলিয়াম মাকপিস থ্যাকারে জুনিয়র লিখিত ১৮৪৪ সালের উপন্যাস ‘দ্য মেমোয়ার্স অব ব্যারি লিন্ডন এস্কোয়ার’ অবলম্বনে সিনেমা বানিয়ে চারটি অস্কার জেতেন। মীরা নায়ার ২০০৪ সালে থ্যাকারের ক্ল্যাসিক ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ চলচিত্রায়িত করেন। এই কাহিনি ১৮৪৮ সালে লিখিত।
ভোপালের ঘটনা
এমিলি ও ট্যালবটের কিনিষ্ঠ পুত্র কর্নেল স্যার রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়রের নাম আবার অন্য এক কারণে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। এই ব্রিটিশ রাজপুরুষ ভোপালের নবাব পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৮৫০-এর দশকে ভোপাল ইংরেজদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল। দক্ষিণের হায়দরাবাদি নিজামশাহির পরে ভোপালই ছিল বৃহত্তম রাজ্য। ওই সময়ে নবাব সিকান্দর বেগম ওঁর মেয়ে নবাব শাহ জাহান বেগমের বিরুদ্ধে ভোপাল রাজ্যের নবাবি পদের দাবিদার হন এবং ও নিজের জন্য ইংরেজদের সমর্থন দাবি করেন। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময়ে সিকান্দর বেগম ইংরেজদের সমর্থন করেছিলেন। তাঁর কারণেই ভোপালে তেমন ভাবে বিদ্রোহ ছড়াতে পারেনি। ব্রিটিশ বিরোধী সমাবেশ, ইস্তেহার বিলি ইত্যাদি তিনি কড়া ভাবে নিষিদ্ধ করেন। তাঁর নিজের গুপ্তচরদের তিনি স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসনকে সাহায্য করতে নির্দেশ দেন, ব্রিটিশ বিরোধী সেনাদের অনেককেই ব্রিটিশ পক্ষে ফিরিয়ে আনেন। ১৮৫৭-র ডিসেম্বরে বিদ্রোহী সিপাহিদের একটি দল তাঁর প্রাসাদ ঘেরাও করে তাঁর জীবন বিপন্নও করেছিল বলে জানা যায়। এর পিছনে আবার ভোপালের নবাব পরিবারের অন্য সদস্যদের মদত ছিল, এ কথাও অনেকে বলেন।
আসল ঘটনা এই যে, সিকান্দর বেগমের মা নবাব কুদসিয়া বেগম ওঁর নাতনি শাহ জাহান বেগমকে নবাব পদের অধিকার দিয়ে যান এবং নিজের মেয়ে সিকান্দরকে দিয়ে যান শুধু মাত্র তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব। সিকান্দর বেগম এই ব্যাবস্থায় একদম খুশি ছিলেন না। তাই ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের সাহায্য করার বিনিময়ে উনি নবাবির অধিকার দাবি করেন। ভোপাল রাজ্যের অভিজাতদের একাংশ কিন্তু এর বিরোধিতা করেন এবং বিদ্রোহী সিপাহিদের সিকান্দর বেগমের বিরুদ্ধে উস্কাতে থাকেন। রাজ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। সিকান্দার বেগম কঠিন হাতে এই বিরোধিতা দমন করেন ও ইংরেজদের বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করেন।
১৮৫৯ সালে স্যার রিচমন্ড ক্যাম্পবেল মা ও মেয়ে—সিকান্দর এবং শাহ জাহান বেগমের সঙ্গে এক বছর ধরে আলাপ আলোচনা করে ভোপাল রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন ও নবাবি সমস্যার মীমাংসা করেন। তেরো বছর মেয়ের হয়ে রাজ্য দেখাশোনা করার পরে ১৮৬০ সালে সিকান্দর বেগম নবাব হন এবং ১৮৬৮ পর্যন্ত ভোপালের নবাব থাকেন। ১৮৬৮-য় সিকান্দর বেগম মারা গেলে শাহ জাহান বেগম ভোপালের নবাব হন। ১৮৬০ সালে রিচমন্ড ক্যাম্পবেল ভোপালের নবাব বেগমদের অর্থাৎ মা ও মেয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করে ভারতে ইংরেজ শাসন বিশেষ ভাবে মজবুত করেন। রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়রের মধুর ব্যবহার ও ভারতের রাজন্যবর্গের সঙ্গে সুসম্পর্ক মহাবিদ্রোহ-পরবর্তীকালে ইংরেজ রাজশক্তির প্রসারণে বিশেষ সাহায্য করে। ১৮৬১ সালে রিচার্ড ক্যাম্পবেল হঠাৎই অসুস্থ হয়ে ইনদওরে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর ঠিক দু’মাস আগে তাঁর পুত্র জন শেক্সপিয়র জন্মগ্রহণ করেন।
কলকাতার দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে এমিলি ও জন ট্যালবট শেক্সপিয়রের সমাধি ও স্মারক । ছবি সৌজন্য:কলকাতা ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল বোর্ড।
কর্নেল স্যার রিচমন্ড ক্যাম্পবেলের মৃত্যুতে গভীর শোকহত হন সাহিত্যিক মামাতো ভাই উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে জুনিয়র। তিনি তাঁর কলাম ‘রাউন্ড এবাউট পেপারস’-এ লেখেন, ছোটবেলার খেলার সঙ্গী পিসতুতো ভাইকে হারিয়ে তিনি মর্মাহত।
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে
ইতিহাসের চাকা চক্রাকারে আবর্তিত হয়। শেক্সপিয়র পরিবারের এই চরাই-উৎরাইয়ের ইতিবৃত্তের উপসংহার কিন্তু ‘ট্র্যাজিক’ নয়। কর্নেল স্যার রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়ার এর ছেলে জন (১৮৬১-১৯৪২) ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির নামকরা অফিসার ছিলেন এবং মিজোরাম ও মণিপুর বিষয়ে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। তিনি এই দুই রাজ্যের উপরে কয়েকটি বইও লিখে গিয়েছেন। বর্তমানে আইজল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর উপরে গবেষণায় ব্যস্ত বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী। জন নিজেও ইতিহাসচর্চা করতেন। ঠাকুমা এমিলি শেক্সপিয়রের লিখে যাওয়া ১৮১৪ সালের ডায়েরি এই জন শেক্সপিয়রই ‘বেঙ্গল পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ (জুলাই-ডিসেম্বর, ১৯১০) পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা আজও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য লেখ্যাগারে রাখা আছে।
জন ট্যালবট শেক্সপিয়র এবং তাঁর স্ত্রী এমিলি ১৮১৪ সালে গভর্নর জেনারেল আর্ল অফ ময়রা ( ফ্রান্সিস এডওয়ার্ড রাউডন হাস্টিংস) -র সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে বজরায় ৪০ দিন কলকাতা থেকে পশ্চিমে ভ্রমণ করেছিলেন। এই কাহিনি এমিলি তাঁর ডায়েরিতে মনোজ্ঞ ভাষায় লিখে গিয়েছেন। এই ভ্রমণ বৃত্তান্তে বিস্তারিত ভাবে ৪০০ বজরা ও নৌকোর একযোগে যাত্ৰা এবং মাঝিদের জীবনের সরস বর্ণনা রয়েছে। এই কাহিনিতে তৎকালীন মুর্শিদাবাদ শহর ও বাংলার নবাব জইন-উদ-দিন আলি খানের হারেম এবং জেনানা মহল সম্পর্কে কটাক্ষও করা হয়েছে।
আর এই ডায়রির মুখবন্ধে লেখা আছে 'ই’ অক্ষর বর্জিত 'শেক্সপিয়র' এবং 'থ্যাকারে' এই দুই ইতিহাস-খ্যাত পরিবারের ইম্পিরিয়াল ভারতে যুগলবন্দির ইতিবৃত্ত।
(লেখক একজন কলামনিস্ট। ‘উইদাউট প্রেজুডিস’ নামের এক গ্রন্থের রচয়িতা। জনসংযোগ এবং ব্র্যান্ড বিল্ডিং বিশেষজ্ঞ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy