বায়ুদূষণের জেরে অনেকেই হাঁপানি, হৃদ্রোগ-সহ বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন। ফাইল চিত্র।
রুজি-রোজগারের তাগিদে বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকার পাথর খাদানে কর্মরত শ্রমিকেরাই যে শুধু ভয়ঙ্কর দূষণে আয়ুক্ষয় করে চলেছেন, তা নয়। খাস কলকাতায় ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসা হকারেরাও দূষণের শিকার। বায়ুদূষণের জেরে তাঁদের অনেকেই হাঁপানি, হৃদ্রোগ-সহ বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন বলে জানাচ্ছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।
করোনার প্রকোপ শুরুর আগে, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০-র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই গবেষকেরা কলকাতার অতি ব্যস্ত চার জায়গায় সমীক্ষা চালান। গড়িয়াহাট, ধর্মতলা-পার্ক স্ট্রিট, শ্যামবাজার-হাতিবাগান এবং বেহালায় ১৮ থেকে ৫৫ বছরের মোট ২৯২ জন হকারের উপরে ওই সমীক্ষা করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১১১ জনের ফুসফুস পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গাড়ির ধোঁয়া, ধুলোর কারণে অধিকাংশ হকারের শরীরে বাসা বেঁধেছে বায়ুর দূষণজনিত বিভিন্ন রোগ। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে দূষণ বিষয়ক পিয়ার রিভিউড জার্নাল ‘পলিউশন’-এ।
গবেষক-দলের অন্যতম সদস্যা নবনীতা ঘোষ জানান, ধূলিকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) হল কঠিন ও বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত তরল কণাগুলির সংমিশ্রণ। সেগুলির মধ্যে ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে কম ব্যাসের কণাকে বলে ‘পিএম২.৫’। ১০ মাইক্রোমিটার বা তার কম ব্যাসের কণার নাম ‘পিএম১০’। এগুলিকে যথাক্রমে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও শ্বাসবাহিত ধূলিকণাও বলা হয়।
গবেষকদের দাবি, আকারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে পিএম২.৫ এবং পিএম১০ কাজ করে গ্যাসের মতো। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময়ে এই দুই কণা ফুসফুস-সহ গোটা শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। যার ফলে হতে পারে হাঁপানির মতো রোগ। গবেষকদের কথায়, আয়তনের ক্ষুদ্রতার দরুণ পিএম২.৫ বেশি বিপজ্জনক। তার দাপটে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদ্রোগের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এই দুই ধূলিকণা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশিই রয়েছে কলকাতার ওই চার জায়গায়।
যৌথ ভাবে এই গবেষণা করেছেন যাদবপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্লোবাল চেঞ্জ প্রোগ্রাম’-এর গবেষকেরা। গবেষণার কোঅর্ডিনেটর বা সমন্বয়কারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক এবং গ্লোবাল চেঞ্জ প্রোগ্রামের কোঅর্ডিনেটর অনুপম দেব সরকার জানান, শহরের ওই চার জায়গায় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাতাসে দূষিত ধূলিকণা সব চেয়ে বেশি থাকে সকাল থেকে দুপুর ও সন্ধ্যা থেকে রাতে। পরিস্থিতি সব চেয়ে খারাপ ধর্মতলা-পার্ক স্ট্রিটে। কোথাও কোথাও হকারেরা সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করেন। এই দূষণ-কবলিত পরিবেশে এত দীর্ঘ সময় থাকার জন্য তাঁদের স্বাস্থ্যের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে।
নবনীতা জানান, বায়ুদূষণের ফলে নিজেদের শারীরিক ক্ষতির বিষয়ে হকারদের স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাঁদের যে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রয়োজন, নেই সেই সচেতনতাও। অধিকাংশ হকারের বক্তব্য, তাঁদের কোনও শারীরিক সমস্যা নেই। ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর সময়ও নেই। প্রায় ৭০ শতাংশ হকারের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকাও নয়। নবনীতারা জানান, স্পাইরোমেট্রি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, হকারেরা শরীরিক সমস্যা নেই বলে জানালেও রাস্তার ধোঁয়া-ধুলোয় তাঁদের অনেকের ফুসফুস মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। হাঁপানি, শুকনো কাশি, অ্যালার্জি, এমনকি হৃদ্রোগও রয়েছে অনেকের। তাই দ্রুত হকারদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় নীতি নির্ধারণের কথা বলছেন গবেষকেরা।
ফুসফুসের রোগের বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা রায়চৌধুরী জানান, একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, দিল্লির এমসে বক্ষরোগের বহির্বিভাগে গত পাঁচ বছরে রোগীর সংখ্যা ২০ গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতার হাসপাতালে খোঁজ নিলেও এর বৃদ্ধি বোঝা যাবে। হকারেরা রাস্তার ধারে যে পরিবেশে দিন কাটান, তাতে যত বেশি ক্ষণ তাঁরা সেখানে থাকবেন, ততই তাঁদের সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানির মতো রোগ বেশি হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।’’
নবনীতাদের গবেষণালব্ধ তথ্যের সঙ্গে সহমত হয়ে হকার সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দেবাশিস দাস জানান, হকারদের স্বাস্থ্য-সমস্যার সমাধানের দাবি তাঁরা বার বার তুলছেন। তাঁদের স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার উন্নতির দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। হকারদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার ব্যবস্থা, বিমা, ৬০ বছরের পরে পেনশন চালু করার দাবিও জানাচ্ছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy