Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ভারসাম্যহীন তরুণীর যত্নে পাঁচ পরিবার

বাবা-মাকে হারিয়ে সম্পূর্ণ একা মানসিক ভারসাম্যহীন ওই তরুণীকে গত এক বছর ধরে যত্নআত্তি করছেন আবাসনের পাঁচটি পরিবারের সদস্যেরা। নিঃস্বার্থ স্নেহ দিয়েই শুধু নয়, তরুণীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে আইনি লড়াই করে চলেছেন তাঁরা।

 ভালবাসা: সেই তরুণীর সঙ্গে তাঁর নতুন অভিভাবকেরা। রবিবার, কাঁকুড়গাছিতে। নিজস্ব চিত্র

ভালবাসা: সেই তরুণীর সঙ্গে তাঁর নতুন অভিভাবকেরা। রবিবার, কাঁকুড়গাছিতে। নিজস্ব চিত্র

জয়তী রাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৯ ০১:৪৭
Share: Save:

আবাসনের দোতলার ফ্ল্যাটে বন্ধ কোল্যাপসিবলের সামনে দাঁড়িয়ে দোলন নাম ধরে ডাকতেই হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন তরুণী। আগন্তুকদের হাতে কিছু আছে কি না দেখতে, ইতিউতি তাকালেন তিনি। পরনে ম্যাক্সি, কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুলের ছিপছিপে মেয়েটি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে পিছনে ঘুরে গেলেন।

আগন্তুকদের মধ্যে থাকা এক মহিলা বলে উঠলেন, “একটু পরেই দুপুরের খাবার আনব দোলন।” মুখ থেকে হাত নামিয়ে হাসলেন তরুণী। বুকের কাছে মুঠো করে ম্যাক্সিটা চেপে ধরে হনহন করে শোয়ার ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি। ঘরের বড় খাটে তার চেয়ে ছোট মাপের তোশক, কোনও চাদর নেই। সেখানে বসেই জোরে জোরে দুলতে শুরু করলেন দোলন। ‘‘হয়তো এ জন্যই ওঁর নামটা এমন।’’ বলে উঠলেন পাশে বসা আবাসিক মিতা ঠাকুর। নিজের আঙুল নিয়ে খেলতে ব্যস্ত তরুণী তখন গুন গুন করে গাইছেন, নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা বুঝি বা পথ ভুলে যায়...। খুবই অস্পষ্ট শব্দে। ‘‘আমরা যাঁরা ওঁকে রোজ দেখি, শুধু তাঁরাই বুঝি কী গাইছে।’’ বলছিলেন তরুণীর পাশে দাঁড়ানো আবাসনের তিন বাসিন্দা।

বাবা-মাকে হারিয়ে সম্পূর্ণ একা মানসিক ভারসাম্যহীন ওই তরুণীকে গত এক বছর ধরে যত্নআত্তি করছেন আবাসনের পাঁচটি পরিবারের সদস্যেরা। নিঃস্বার্থ স্নেহ দিয়েই শুধু নয়, তরুণীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে আইনি লড়াই করে চলেছেন তাঁরা। এক বাড়িতে থেকেও বাবা-মাকে না দেখা, কিংবা সম্পত্তির লোভে আপন জনের মধ্যে শত্রুতা— এমন অমানবিক খবর শুনে অভ্যস্ত জীবনে এই উদাহরণ দেখে মন ভাল হয়ে যায়। বলছিলেন আবাসনের মাঠে হাঁটতে আসা একদল বৃদ্ধ।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক সুনীলকুমার দাসের উত্তরসূরী এই তরুণী সহেলি দাস। কাঁকুড়গাছির একটি আবাসনের পুরনো বাসিন্দাদের কাছে দোলন নামেই পরিচিত তিনি। বাবা মারা গিয়েছেন ১৯৯৭ সালে। ২০১৪ সালে মা মঞ্জুশ্রী দাসের মৃত্যু হয়। আত্মীয় বিবর্জিত মেয়ের ভরসা হন এক আয়া। এক বছর আগে আয়া যখন তাঁকে ছেড়ে যান, তখন সম্পূর্ণ একা হয়ে যান তরুণী। প্রায় তিন রাত তালাবন্ধ ঘরে জল-খাওয়া ছাড়া ছিলেন তিনি। চিৎকার করা বা চাহিদা প্রকাশের ক্ষমতা কোনওটাই নেই তাঁর। বিষয়টি জানতে পারেন এক আবাসিক।

এর পরেই দোলনের পাশে দাঁড়ান বছর আশির জ্যোতিপ্রকাশ ভট্টাচার্য, সত্তর বছরের নীতিশ দত্ত, পার্থ সরকার, পরিমল চক্রবর্তী এবং মিতা ঠাকুর। গত বছরের এপ্রিল থেকে এঁরাই দোলনের চার বেলার খাবার এবং যাবতীয় খরচ বহন করছেন। ইলেকট্রিক বিল, আয়ার টাকা, ফ্ল্যাট মেরামতির খরচ, জামাকাপড় এবং তোশকের খরচ সবই দেন নীতিশবাবু। দুপুরের খাবার ওঁর কাছে পাঠিয়ে দেন মিতাদেবী। নির্দিষ্ট সময়ে সে সবই পৌঁছে যায় দোলনের ঘরে।

পাশাপাশি, দোলনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে দৌড়ঝাঁপ করে চলেছেন নীতিশবাবু। কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেনশন বিভাগ, কখনও আর জি কর হাসপাতাল, কখনও বা হোমের সন্ধানে ছুটে যাচ্ছেন। পাশে রয়েছেন চার জন। মিতার কথায়, ‘‘দোলনের বয়স প্রায় বত্রিশ। এই বয়সের মেয়ে নিরাপত্তার প্রয়োজন। চেষ্টা করছি। জানি না কত দিন দিতে পারব। কাকুদের তো বয়স হচ্ছে!’’

নীতিশবাবু এবং জ্যোতিবাবু বলছেন, ‘‘একটা মেয়ে অসহায় ভাবে পড়ে থাকবে, শুধু দেখেই যাব! নিজেদের সামর্থ মতো পাশে থেকেছি।’’ গুন গুন করে গাইতে থাকা দোলনের মাথায় হাত রেখে নীতিশবাবু বলে ওঠেন, মেয়েটার উপরে বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে ওঁর ভবিষ্যৎটা সামলাতে চেষ্টা করছি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Girl Mentally Distarted
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy