Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘ইচ্ছে তো খুব, কিন্তু বাবার মতো কে শেখাবে?’

থরথর করে কাঁপছে থুতনি। গুমরে ওঠা কান্নাটা চেপে ধরতে অনেক ক্ষণ ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন রীতা লাহিড়ী। বছর পনেরোর ছেলে দুর্জয় তখন সোফায় বসে। মেঝেয় চোখ স্থির।

 স্মৃতি: বাবার ছবি হাতে দুর্জয়। সোনারপুরের বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র

স্মৃতি: বাবার ছবি হাতে দুর্জয়। সোনারপুরের বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৯ ০২:১০
Share: Save:

‘‘স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ম্যাজিকের সরঞ্জাম। লাখ টাকা মূল্যের সে সবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স‌ংসার দেখব, না জিনিসপত্র সামলাব বলতে পারেন? ছেলেকেও তো আমাকেই দেখতে হবে।’’

থরথর করে কাঁপছে থুতনি। গুমরে ওঠা কান্নাটা চেপে ধরতে অনেক ক্ষণ ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন রীতা লাহিড়ী। বছর পনেরোর ছেলে দুর্জয় তখন সোফায় বসে। মেঝেয় চোখ স্থির। জানলার পাশ থেকে মেঘলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। শরতেও মুখ ভার আকাশের। দশভুজার আগমনি বার্তা যে রটে গিয়েছে, এ ঘরে বসে তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। বৃষ্টি হচ্ছে রাত থেকেই। সকালে কিছুটা ধরেছে। রাতের বৃষ্টিতেই জল থইথই সোনারপুরের চণ্ডীতলা। বাইরে গাছের পাতা তখন সবুজ হয়ে রয়েছে।

রীতা বলে চলেন, ‘‘জানেন, এক বার বলেছিলাম এ সময়ে এই শো করো না। কিন্তু যেটার ঝোঁক চাপত, সেটাই করত। সারাদিন শুধু ম্যাজিক আর ম্যাজিক!’’ কথা শেষ হয় না, ফোঁপাতে থাকেন রীতা। তাঁর পিছনের টেবিলে ম্যাজিক শোয়ে পাওয়া পুরস্কার এবং শংসাপত্র পরপর সাজানো। টেবিলের সামনে-পিছনের দেওয়ালে অজস্র নানা শোয়ের। দেওয়ালের এক দিকে হেলান দিয়ে রাখা বড় ফটো। পরনে ম্যাজিকের পোশাক। মাথায় পাগড়ি। এই যেন ফটো থেকে বেরিয়ে এসে ‘গিলি গিলি গে’ বলবেন!

ফোঁপাতে ফোঁপাতেই রীতা বললেন, ‘‘ম্যানড্রেক ছাড়া অন্য নামে কেউ চিনুক, তা চাইত না একদম। অথচ দেখুন দুর্ঘটনার সাড়ে তিন মাসের মধ্যেই সকলে ভুলে গেলেন।’’

কাঁদতে দেখে সোফা থেকে উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল দুর্জয়। বলল, ‘‘পুজোর সময়টুকু শুধু বাবা সঙ্গে থাকত। না হলে সারা বছরই শোয়ের জন্য বাবা-মা-কে বাইরে থাকতে হত। পুজোর সময়ে বাবা-মা আর আমি একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম।’’

‘‘আমাদের ভালবেসে বিয়ে। আমি ওকে মঞ্চে সাহায্য করতাম। এর আগে অনেক বার বাক্সের মধ্যে ঢুকে গঙ্গায় নামা, হাতে শিকল বেঁধে ট্রেনলাইনে পড়ে থাকা, এ রকম অনেক ঝুঁকির খেলা দেখিয়েছে। বলত ঝুঁকিই তো জীবন।’’—রীতা বলে চলেছেন।

সফল হবেনই। এ বারও এমন নিশ্চিত ছিলেন চণ্ডীতলার বাসিন্দা চঞ্চল লাহিড়ী ওরফে ম্যানড্রেক। ১৬ জুন, যে দিন সকালে গঙ্গায় ‘ডেথ ডাইভ’ ম্যাজিক দেখানোর কথা, সে দিনও অন্য দিনের মতোই নিজের প্রিয় ঘরটায় বসে মিটিং করেছিলেন সকলের সঙ্গে। গঙ্গায় হাত-পা বেঁধে ফেলা হবে তাঁকে। সব খুলে নিজেকে মুক্ত করে অতল জলরাশি ঠেলে অত্যাশ্চর্য ঘটনার মতো সাঁতরে উঠবেন তিনি! স্বপ্ন ছিল এটাই।

স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১৭ জুন গঙ্গা থেকে শুধু নিথর দেহটাই উঠেছিল।

‘‘সকলে বলছে ও নাকি নিজেকে খুলতে পারেনি। বাজে কথা। ও নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করেছিল। কিন্তু স্রোতের এত টান ছিল।...’’ থামলেন রীতা। চোখের জল মুছে চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘‘আমি চাই দুর্জয় ম্যাজিক শিখুক। শো করুক।’’

দূরে মেঘ জমছে। আবার বৃষ্টি হবে।

‘‘কাপড়গুলো তুলে আনি বাইরে থেকে।’’

ছেলেকে একা ঘরে রেখে মা কাপড় তুলতে বেরিয়ে যান।

বড় হয়ে কী হওয়ার ইচ্ছে? বাবার মতো জাদুকর?

বাবার ছবির দিকে এক বার তাকায় ছেলে। গলাটা নামিয়ে বলে, ‘‘ইচ্ছে তো খুব, কিন্তু বাবার মতো কে শেখাবে? মা বলে ম্যাজিক করতে অনেক টাকা লাগে।’’

আবার মেঝেয় চোখ দুর্জয়ের। কাপড় এনে ঘরে জড়ো করছেন রীতা। বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। ঘরও অন্ধকার হয়ে এসেছে। ঘরে আলো জ্বলে উঠল।

‘‘দাঁড়ান চা করে আনি।’’ চা বানাতে চলে গেলেন রীতা।

ঘরে ফের একা ছেলে। ‘‘আমার জন্মদিন ছিল ১০ জুন। এই প্রথম বার বাবা আমার জন্মদিনে বাড়ি ছিল। তার ছ’দিন পরেই...।’’ ছেলে থামে। বাবাকে হঠাৎ হারিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া উদভ্রান্ত কৈশোরের চোখের কিনারে তখন জল! তালু দিয়ে জল মুছে নেয় সে। আস্তে আস্তে যেন কোনও এক গভীরে ডুব দেয়। কোনও এক পূরণ না হতে পারা আকাঙ্ক্ষা-আশার গভীরে।

অতল জলরাশি। তীরে ভর্তি মানুষ। উৎসুক জনতার চোখ ঢেউয়ে। ছেলে ঝাঁপ দিল গঙ্গায়। হাত-পা বাঁধা। বাবার মতো। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। এক-দু’-তিন মিনিট। পাড়ে দাঁড়ানো লোকেদের মধ্যে উসখুস শুরু হয়েছে। তা হলে কী?...চিন্তা শেষ হয় না। হাত-পায়ের দড়ি খুলে অতলান্ত জলরাশি ঠেলে ভেসে ওঠে ছেলে। এক বার আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। মুখে বিজয়ীর হাসি! শেষ বার বাবা পারেনি। ছেলে জিতে গিয়েছে ম্যাজিককে সঙ্গী করে!

‘এই নিন চা!’

চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছেন মা। মায়ের গলায় ঘোর কাটে ছেলের। ঘোর কাটে সারাটা ঘরের।

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফ্রেমবন্দি বাবা নির্নিমেষে ছেলের দিকে তাকিয়ে।

বড় হয়ে ছেলে পারবে তো সত্যি? অতলকে হারাতে?

আরও একটু ঘন হয় মেঘ। আরও একটু ঘন হয়ে আসে গাছের ছায়া!

অন্য বিষয়গুলি:

Death Magician
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy