দমদমে রাস্তা জুড়ে পড়ে নির্মাণ সামগ্রী। অভিযোগ, তা নিতে গেলেও দ্বারস্থ হতে হয় স্থানীয় নেতাদের। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
এটাই পদ্ধতি।
তবে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের নেতা-কর্মীদের তোলাবাজি, কাটমানির টাকা ফেরত দিতে বলার পরে সেই পদ্ধতি নিয়ে শোরগোল জোরদার হয়েছে। জেলায় জেলায় টাকা ফেরতের দাবিতে নেতা-কর্মীদের বাড়ি ঘেরাও চললেও শহর কলকাতাও সেই ব্যবস্থার বাইরে নয়।
ভুক্তভোগীদের অনেকেরই মত, রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দাদাদের তোলাবাজি সবচেয়ে বেশি চলে আবাসন এবং ফ্ল্যাট তৈরির নামে। শুধু বালি-পাথরকুচি-ইট কেনা নয়, তাঁদের ‘দাক্ষিণ্যে’ তৈরি হয় পুরো আবাসনই। বর্গফুট পিছু নিজেদের ভাগ বুঝে নিয়ে তবে ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য প্রোমোটারের হাতে চাবি তুলে দেন তাঁরা। কোথাও রেট প্রতি বর্গফুট ৪০০ টাকা। কোথাও হাজার ছুঁই ছুঁই। এ ছাড়াও রয়েছেন ‘সেটিং দাদা’। যিনি মোটা অঙ্কের দক্ষিণা নিয়ে পুরসভায় নকশা অনুমোদন থেকে জলের ব্যবস্থা— সব করিয়ে দেবেন নিজের ‘জাদু’তে। দক্ষিণা না দিলে? পাততাড়ি গোটাতে হবে।
হিসেব সহজ।
দক্ষিণ কলকাতার ৯৬ নম্বর ওয়ার্ডে আবার অন্য রকম ‘ব্যবস্থা’। এক ভুক্তভোগী প্রোমোটার বললেন, ‘‘পুরসভার অনুমোদন নিয়ে একটি প্লটে কাজ করছিলাম। স্থানীয় এক নেতা জানালেন, পুরসভার ব্যাপারটা দেখে দেবেন। কিন্তু, আবাসনের একতলার গ্যারাজটা তাঁর লাগবে! স্পষ্ট জানিয়ে দিই, পুরসভার অনুমোদন নেওয়া রয়েছে। সাহায্যের প্রয়োজন নেই। এর পরে ওই নেতা বলেন, আমার মনে হয়, কাজটা একা করতে পারবেন না। চেষ্টা করে দেখতে পারেন, তবে আমার সাহায্য ছাড়া আবাসনে তো জলই ঢুকবে না।’’ বাধ্য হয়ে আবাসনের গ্যারাজটি ওই নেতাকে লিখে দিতে হয় বলে দাবি প্রোমোটারের। ওই ওয়ার্ডে এমন প্রায় ১০টিরও বেশি গ্যারাজ ওই নেতার নামে রয়েছে বলে খবর। ফলে তাঁর ডাকনামের আগে স্থানীয়েরা সাধারণত ‘গ্যারাজ’ শব্দটি উল্লেখ করেন। স্থানীয় কাউন্সিলর দেবব্রত মজুমদার ওরফে মলয়বাবু এ ব্যাপারে বলেন, ‘‘এমন কোনও অভিযোগ পাইনি। প্রোমোটার অভিযোগ করলেন না কেন?’’
গত ১০ জুন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে চালু হয়েছে তাঁর দফতরের গ্রিভান্স সেল। কাটমানি এবং তোলাবাজি সংক্রান্ত অভিযোগ সেখানে জমা পড়ছে। তবে সেই সেল চালুর আগে অভিযোগ করার কী মাসুল দিতে হয়েছে, শোনাচ্ছিলেন শিয়ালদহের একটি লটারি সংস্থার কর্তা। বেলেঘাটার অবিনাশচন্দ্র ব্যানার্জি লেনে একটি জমিতে প্রোমোটিং করার কথা ছিল তাঁদের। পুরসভা থেকে অনুমোদনও পাশ হয়ে যায়। তবে দু’বছর কেটে গেলেও সেখানে কাজ শুরু করা যায়নি।
অভিযোগ, বেলেঘাটার কয়েক জন স্থানীয় তৃণমূল নেতা জমিটি তাঁদের লিখে দিতে হবে বলে চাপ দেওয়া শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের কাছেও যান ওই লটারি সংস্থার মালিকেরা। কিন্তু কিছু করা যায়নি। উল্টে ‘‘নেতাদের কাছে গিয়েছেন? কিছু হয়ে গেলে ওঁরা বাঁচাবেন তো?’’ জাতীয় কথা শুনতে হয়। স্থানীয় থানায় গেলেও যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদেরই ডেকে পাঠিয়ে থানা থেকে বলা হয়, ‘‘দেখুন আপনার নামে অভিযোগ হচ্ছে। মিটিয়ে নিন।’’ শেষে যাঁরা হুমকি দিচ্ছিলেন, তাঁদেরই জমিটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় ওই লটারি সংস্থা। সেখানকার এক কর্তা বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এখন কাটমানির কথা বলছেন? আর এ নিয়ে কিছু বলতে চাই না। জমি আমরা বেচে দিতে বাধ্য হয়েছি। লোক লাগিয়ে অনেক হুমকি দেওয়া হয়েছে।’’
লোক লাগানোর গল্প শোনালেন উত্তর কলকাতার এক যুব তৃণমূল নেতা। লোকসভা ভোটের পরে একটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার নাম করে তিনি বলেন, ‘‘কোথাও বড় কোনও প্রোজেক্ট হলে দাদা আমাদের সেখানে পাঠান। আমরা গিয়ে ঝামেলা পাকাতাম, আমরাই ঝামেলা মেটাতে দাদার কাছে নির্মাণ সংস্থার কর্তাদের নিয়ে যেতাম। বন্ধ ঘরের মধ্যে দাদা সব সেট করে নিতেন।’’
এই ‘সেটিং পদ্ধতি’র জন্যই ফ্ল্যাটের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না বলে অভিযোগ তুলেছে নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই। সংস্থার তরফে সুশীল মোহতা বলেন, ‘‘সিন্ডিকেটের সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভুগেছি আমরা। ওদের নির্ধারিত দামে নির্মাণ সামগ্রী নিতে গিয়ে ফ্ল্যাটের দাম অনেক ক্ষেত্রেই বেড়েছে। সিন্ডিকেটের জুলুম বন্ধ হলে সত্যিই উপকৃত হব।’’ রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষামন্ত্রী সাধন পাণ্ডে তোলাবাজি ও কাটমানির কথা মেনে নিয়েই বললেন, ‘‘নেত্রীর নির্দেশে কোনও রকম কাটমানি, তোলাবাজি বরদাস্ত করা হবে না। এটাই স্পষ্ট কথা।’’
তবে এই স্পষ্ট কথার পরেও কাজ হবে তো? উত্তর নেই কোনও মহলেই!
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy