Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus in Kolkata

‘দিদিকে বলেছিলাম, মারা গেলে পরিবারকে জানিও’

কোভিড-যুদ্ধের একেবারে সামনের সারির সেনানী ওঁরা। ওঁদের কলমে, ওঁদেরই গল্প।অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কোভিড মারাত্মক সংক্রমণ হলেও ঠান্ডা মাথায় এর মোকাবিলা করা সম্ভব।

শাহ হোসেন বারি

শাহ হোসেন বারি

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২০ ০৪:১৩
Share: Save:

কোভিড কী? ছ’মাস আগেও জানতাম না। তবে আজ মনে হচ্ছে, কোভিডের সঙ্গে ঘর-সংসার করে প্রায় পোষ মানিয়ে ফেলেছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কোভিড মারাত্মক সংক্রমণ হলেও ঠান্ডা মাথায় এর মোকাবিলা করা সম্ভব।

জুনের ১৯ থেকে জুলাইয়ের ৩১। এই সময়ের মধ্যে দু’বার পজ়িটিভ রিপোর্ট এসেছিল। প্রথম বার সস্ত্রীক ১২ দিনের হাসপাতালবাস। দ্বিতীয় বার শুধু আমারই রিপোর্ট পজ়িটিভ এসেছিল। ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধ আর বিশ্রামে বাড়িতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিলাম। প্রথম বারের হাসপাতাল ও কোয়রান্টিন পর্ব কাটিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ফের আক্রমণ। কোনও বারই সর্দি-কাশির উপসর্গ ছিল না। দু’বারই পেটের গোলমালে কোভিডের আভাস পেয়েছিলাম। প্রথম বার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিল। পরীক্ষায় কোভিড ধরা পড়ার পরে শুরু হয়েছিল চিকিৎসা। দ্বিতীয় দফায় জ্বরও আসেনি। অসম্ভব দুর্বলতা ছিল দু’বারই।

অনেক সময়েই আমরা রোগী বা তাঁর পরিবারের সরাসরি সংস্পর্শে চলে আসি। বার বার সংক্রমণের মূল কারণ হয়তো এটাই। হয়তো শুনলাম, কোথাও কোভিড রোগী পড়ে গিয়েছেন। দ্রুত সাধারণ পোশাক, গ্লাভস আর মাস্ক পরেই ছুটলাম। রোগীর পরিজনের উত্তেজিত হওয়ার খবর পেলেই ছুটে গিয়েছি। পিপিই পরার সময় কোথায়? তখন নিজের কথা মনে থাকে না। এই কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা আবেগে চলেন। দিনের শুরুর দিকে এক বার চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ইনফেকশন কন্ট্রোল টিমের সঙ্গে টহল দিতে কোভিড ওয়ার্ডে যেতেই হয় আমাদের। এ ছাড়া পরিষেবা নিয়ে রোগী অভিযোগ করলে, কোনও যান্ত্রিক সমস্যা বা কোনও জরুরি প্রয়োজনে ওয়ার্ডে ঢুকতে হয়। সেই সময়ে অবশ্য পিপিই পরা থাকে।

সংক্রমণের শুরুর পর্ব আমাদের কাছে ছিল খুব কঠিন। এক মহিলার চিকিৎসা করতে গিয়ে অজান্তে আক্রান্ত হন দুই চিকিৎসক। সেটাই মেডিক্যালে প্রথম সংক্রমণ। তখনও মেডিক্যাল কোভিড হাসপাতাল হয়নি। পিপিই পরিয়ে, খাবার দিয়ে অনেকের সঙ্গে আমিও তাঁদের তাই বেলেঘাটা
আইডি-তে রওনা করিয়েছিলাম। সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভেঙে পড়েছিলেন দুই চিকিৎসক।

যদিও ফেব্রুয়ারির শেষেই কোভিড যুদ্ধে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ এসেছিল স্বাস্থ্য ভবন থেকে। সব প্রস্তুতি সারতে মার্চ পেরিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে পরিবারকে সরানোর কাজটাও করেছিলাম। কলিন্স লেনে আমার বাড়ি। মা-বাবা আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকতাম। স্ত্রী কলকাতারই আর একটি হাসপাতালের নার্স। বাবা-মায়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে মুর্শিদাবাদের রেজিনগরে দাদার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

রোজ রাতে এক বার করে ফোন করে বাবা, মা আর দাদার সঙ্গে কথা বলি। বোনের খবর নিতে ফোন করি। স্ত্রীর সঙ্গে সারাদিনের গল্পে কেটে যায় ঘণ্টা দুয়েক। ধর্মীয় বই পড়ার সময় বাড়িয়ে দিয়েছি। খাবারের তালিকায় বেশি করে প্রোটিন থাকে। দিনে এক বার করে ভেপার নিচ্ছি।

এক জেঠতুতো দিদি ছাড়া কেউ জানতেনই না যে আমাদের কোভিড হয়েছিল‌! সে কথা শুনলে বরং বাবা-মা চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। দিদিকে বলেছিলাম, মারা গেলে পরিবারকে জানিও।

প্রিয় মানুষকে হারিয়ে পরিবারের সর্বস্বান্ত মন যে আমি চিনেছি। সেই মনকে শান্ত করতে মর্গে নিয়ে গিয়ে ডোমকে বলে মৃতের মুখ দেখিয়ে দিয়েছি পরিজনকে। সেই তীব্র কষ্টের বিষ আমার গলাতেও কান্নার দলা হয়ে আটকে যায়।

আবার যখন দেখি, গোটা পরিবার কোভিড আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে, সেই মুহূর্তের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মনে হয়, এটা আমার পরিবারের সাফল্য।

বাড়ি ফেরার পথে শুনশান পার্ক স্ট্রিট বড্ড কষ্ট দেয়। খোলা রেস্তরাঁর সামনে শুধুই পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দারোয়ান। খাবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষায় মুখের ভিড় খুঁজে ফিরি প্রতি রাতে। এক দিন পাব নিশ্চয়ই।

(অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল)

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus in Kolkata Covid Warrior
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy