হাসিমুখ: হাওড়ার ইছাপুরের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দেবারতি দাস। রবিবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
বাড়ির দরজা একটু জোরে বন্ধ হলেই আতঙ্কে কেঁপে উঠছেন। যে কোনও জোরালো শব্দে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে তাঁর। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত খারকিভ থেকে প্রাণ হাতে ফিরে এলেও আতঙ্ক যে এখনও পিছু ছাড়ছে না, তা নিজেই মানছেন ইউক্রেন থেকে হাওড়ার ইছাপুরে ফিরে আসা ডাক্তারির পড়ুয়া দেবারতি দাস। কানে সমানে বেজে চলেছে বোমা, গুলি, শেল, মর্টারের আওয়াজ আর আর্তনাদ। এর পরেও দেবারতি অবশ্য বলছেন, ‘‘দেশটা আগের মতো হয়ে গেলে আমি ফিরে যাব।’’
কলকাতা বিমানবন্দরে জেলাশাসকের পাঠানো গাড়িতে চেপে শনিবার রাত আড়াইটে নাগাদ হাওড়ার ইছাপুর কামারডাঙার বাড়িতে ঢোকেন দেবারতি। গত এক সপ্তাহ ধরে মেয়ের জন্য রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় থাকা বাবা নন্দলাল দাস ও মা রূপালি দাসও রাতে হাজির ছিলেন বিমানবন্দরে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা। রাতে বাড়ি ফেরার পরে জগাছা থানার পদস্থ পুলিশ অফিসারেরা এসে দেখাও করেছেন। ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছেন দেবারতির। রবিবার ঘুম ভাঙার পর থেকে দিদির সঙ্গে গল্পে মেতে থাকতে দেখা গিয়েছে ভাই অগ্নীশ্বরকে। সেই সঙ্গে আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশীদের শুভেচ্ছা জানানোর পালা তো চলেছেই।
চোখের সামনে দেখা যুদ্ধের হাড় হিম করা অভিজ্ঞতা আর সেখান থেকে বেঁচে ফেরার লড়াই করে দৃশ্যত ক্লান্ত দেবারতি বলেছেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই দেখেছি, ইউক্রেনীয় ও ভারতীয় পড়ুয়াদের মধ্যে অদৃশ্য পাঁচিল ছিল। যুদ্ধ শুরুর পরে দেখলাম, সেই পাঁচিলই যেন চওড়া হয়েছে। যার ফলে সাধারণ ইউক্রেনীয়দের থেকে কোনও সাহায্য পাইনি। বরং নানা বাধা পেয়েছি।’’
দেবারতি জানাচ্ছেন, সীমান্তে আসার জন্য যে স্টেশন থেকে তাঁরা ট্রেনে উঠেছিলেন, সেখানে তাঁদের বসতে দেওয়াও হয়নি। ২৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে। যদিও সে দেশের নাগরিকদের সঙ্গে থাকা পোষ্যের জন্য বরাদ্দ ছিল আসন।
দেবারতি জানাচ্ছেন, তাঁরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, পড়ুয়াদের রক্ষা করতে সেই খারকিভ ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ভূমিকা ছিল অনবদ্য। বাঙ্কারে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থেকে নিরাপত্তা, সব বুক দিয়ে সামলেছেন আর এক ভারতীয় অধ্যাপক ও তাঁর স্ত্রী। দেবারতি বলেন, ‘‘যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে ট্রেনে ওঠা পর্যন্ত সব দিক দেখভাল করেছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় অধ্যাপক করণ সাঁধু ও তাঁর স্ত্রী নাতাশা সাঁধু। এখনও যে সব পড়ুয়া ওখানে আটকে রয়েছেন, তাঁদের ছেড়ে আসেননি ওঁরা। বলেছেন, সবাইকে দেশে ফেরত না পাঠিয়ে নড়বেন না। ওই দু’জন মানুষের অবদান ভোলার নয়।’’
এমবিবিএসের দ্বিতীয় বর্ষ শেষ হতে দেবারতির বাকি ছিল মাত্র তিন মাস। সে দেশে সমস্ত কিছু ফেলে একটা ছোট ব্যাগে শুধু জরুরি কাগজ ভরে বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। চোখ বুজলেই তাই সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
এক দিকে যেমন এখনও কানে ভেসে আসছে গোলাগুলির শব্দ, পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বাড়ি ফিরে আসায় তেমনই ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে মনও। দেবারতি ও তাঁর পরিবারের এখন অন্য চিন্তা। মেয়ে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছেন, এটা যেমন নিশ্চিন্তের, পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, ভারতে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ না পেয়েই তো অন্য দেশে যেতে হয়েছিল দেবারতিদের। কিন্তুএর পর?
‘‘আচমকা যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এত ভারতীয় ডাক্তারি পড়ুয়াকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। আমাদের এই বিশাল দেশে তো এত মেডিক্যাল কলেজ আছে, সেখানে এঁদের পাঠ্যক্রম শেষ করার ব্যবস্থা কি করা যায় না? এ দেশে তো অনেক চিকিৎসকের প্রয়োজন।’’ প্রশ্ন তুলছেন দেবারতির বাবা।
ইউক্রেন থেকে ফিরে আসার লড়াই দেবারতির শেষ হয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে এ বার শুরু হয়েছে দেবারতিদের নতুন লড়াই। ভবিষ্যৎ তৈরির লড়াই ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy