প্রতীকী চিত্র।
৫ অগস্ট।
দিনটা বোধহয় আসারই ছিল। পাঁচ মাস ধরে যে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, সে তো পাল্টা দেবেই। আমি তো সেফ হোমের চিকিৎসক। পরিবেশ সেখানে যতই ঝকঝকে হোক, লুকনো শত্রুর মতো কোভিড-১৯-এর ভাইরাস তো সেখানে অদৃশ্য ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাসখানেক হল সেফ হোমে কাজ করলেও গত পাঁচ মাস ধরে রোগীকে হাসপাতালে পাঠানো থেকে শুরু করে করোনার মোকাবিলায় প্রচার— সবের সঙ্গেই থাকতে হয়েছে। তার পরে তো এখন উপসর্গহীন (জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট নেই) রোগীদের সঙ্গে সেফ হোমে নিশিযাপন। চিকিৎসা করতে করতে সব সময়ে মনেও থাকে না যে অতিমারির সামনে আমি শুধুই ডাক্তার নই, এক জন মানুষও বটে। ফলে দু’দিন জ্বরের পরে ৫ অগস্ট, যে দিন আমার সোয়াব টেস্টের রিপোর্টে ধরা পড়ল যে আমি করোনা পজ়িটিভ, সে দিন মনে হয়েছিল এটা তো হওয়ারই ছিল।
তবে ঘাবড়ে যাইনি। বেসরকারি কোভিড হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে ফোনে রোগীদের খোঁজখবর নিতাম। ডায়মন্ড হারবার এসডিও মাঠের সেফ হোম ছিল আমার কাজের জায়গা। সেখানে সরকারি হাসপাতালের মতোই বিছানা। তবে খুব সুন্দর। পরিষ্কার তোশক, চাদর। পরিস্রুত জলের জন্য ফিল্টার। মন ভাল রাখার জন্য গান বাজানো হয়। ডায়মন্ড হারবার স্বাস্থ্য জেলায় আমাদের সেফ হোম এমনই।
ডায়মন্ড হারবার স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবাশিস রায়ের একটি ফোন ও চিঠি থেকে জানতে পারি সেখানে এসডিও মাঠের স্টেডিয়ামে যে ঘরগুলি রয়েছে, সেখানে ১০০ শয্যার সেফ হোম চালু হবে। ডায়মন্ড হারবার-সহ সুন্দরবন এলাকাতেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাই উপসর্গহীন রোগীদের রাখা হবে সেফ হোমে।
রোগী ও চিকিৎসাকর্মীদের মন ভাল রাখতে সেফ হোমে রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়তো আধুনিক গান বাজানোর ব্যবস্থাটা আমাদের এখানে অভিনব। রোগীদের খাবারের তালিকা ও সময়সূচি দেওয়ালে আটকে দেওয়া আছে। পানীয় জলের ফিল্টার রয়েছে পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডের মধ্যেই। রোগীদের জন্য জলের বোতল, গুঁড়ো সাবান, মাজন, ব্রাশ সবই দেওয়া হয়। সারা দিনে দু’বার টিফিন ও দু’বার পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয়।
সেফ হোমের ভিতরে একটি বড় টেবিলের এক দিকে খাবার দেওয়া হয়। অন্য দিকে মেডিক্যাল পরীক্ষা চলত। রোগীদের কাগজপত্র, রিপোর্ট সবই আমি দেখতাম। তাই অনেকেরই নাম ও ঠিকানা মুখস্থ হয়ে যেত। রোগীর ছুটিতে আনন্দ হত।
সেফ হোমের রোগীদের কেউ পুলিশকর্মী, কেউ সাধারণ কর্মচারী, কেউ আবার একেবারেই সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখানে সবাই এক পরিবারের সদস্যদের মতোই।
দীর্ঘ পাঁচ মাসের বেশি সময় ডায়মন্ড হারবার মহকুমার ১ নম্বর ব্লকে কাজ করেছি। করোনা মোকাবিলায় সচেতনতার প্রচার, করোনা রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো, রোগীর বাড়ির লোকেদের করোনা পরীক্ষা করানো, তার আগে পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কোয়রান্টিন সেন্টারের দায়িত্ব সামলানো, সবই করতে হয়েছে। তাই করোনাভাইরাস যে সুযোগ পেলেই আমাকে ছাড়বে না, সেটা ধারণার মধ্যেই ছিল।
রিপোর্ট পজ়িটিভ আসার পরে টাইফয়েড, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে কলকাতার একটি বেসরকারি কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হলাম। তার পরে সুস্থও হয়ে গেলাম। সাত দিন বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার পরে ফের করোনা পরীক্ষা করানোয় রিপোর্ট নেগেটিভ এল।
কিন্তু খারাপ লাগল এটা দেখে যে, করোনা হওয়ায় আমি এবং আমার পরিবার যেন এই সমাজ থেকেই ব্রাত্য হয়ে গেলাম। প্রতিবেশীর সংখ্যা কমে গিয়েছে। অনেকেই দূরত্ব-বিধি মানার নাম করে আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের সকলেরই করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের একঘরে করা হয়েছে।
সুস্থ হওয়ার পরে এখন আবার আমি ডায়মন্ড হারবারে, আমার সেফ হোমে, রোগীদের সঙ্গেই। এই লড়াই আপাতত চলবে।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy