সময়টা আঠারো শতকের শেষের দিক। পলাশির যুদ্ধ জিতে, এমনকি মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা আর বাংলার নবাব মিরকাশিমের মিলিত বাহিনীকে বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪) হারিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা তখন দেখে কে! আইনি-বেআইনি পথে টাকা উড়ছে বাতাসে, বুদ্ধি করে কব্জা করার অপেক্ষা। ‘হঠাৎ নবাব’ হওয়ার আশায় অনেকেই ভারতে যেতে চাইছেন, শিল্পীরাও ছিলেন সেই দলে। প্রথম দিকে টিলি কেটল, জন জোফানি কি টমাস হিকি-র মতো যাঁরা এলেন, তাঁরা মূলত প্রতিকৃতি-শিল্পী। কিন্তু অজ্ঞাত দেশের বহুবিচিত্র নিসর্গচিত্র ইউরোপের সমঝদারদের সামনে তুলে ধরার কথা প্রথম ভেবেছিলেন উইলিয়াম হজেস। ক্যাপ্টেন কুক-এর অভিযানে শিল্পী হিসেবে ঘুরে এসে অভিজ্ঞতা আর আগ্রহ দু’টোই ছিল তাঁর, আর ভারতে এসে পেয়েছিলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের পোষকতা। ১৭৮০-৮৩ ভারতে থাকলেও উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্য খুব ভাল ভাবে ঘুরতে পারেননি হজেস, যেতে পারেননি দিল্লিতেও। তবু তাঁর সিলেক্ট ভিউজ ইন ইন্ডিয়া অন্যদের চোখ খুলে দিয়েছিল। টমাস আর উইলিয়াম ড্যানিয়েল, খুড়ো-ভাইপো সেই পথেই পা বাড়িয়ে কলকাতা পৌঁছন ১৭৮৫-১৭৮৬’র শীতে। টমাসের বয়স তখন ছত্রিশ, উইলিয়ামের ষোলো।
কী করতে চান, তা নিয়ে দু’জনের ভাবনা ছিল স্পষ্ট। কলকাতায় এসে তাঁরা শহরের বারোটা ছবি এঁকে ফেললেন (ছবিতে একটি), দু’বছরের মধ্যে অ্যাকোয়াটিন্টে ছাপাও হয়ে গেল ভিউজ় অব ক্যালকাটা। নতুন শিল্পীদের প্রথম কাজ সাড়া ফেলেছিল, কারণ এ থেকেই তাঁরা প্রথম সফরের পাথেয় জোগাড় করেন। হজেসের আঁকা ছবি তত দিনে শহরে এসেছে, ড্যানিয়েলরা ঠিক করে ফেললেন হজেসের দেখা জায়গাগুলোতে যাবেন, আরও ভাল ছবি আঁকবেন।
সাত বছর ভারতে কাটিয়ে ড্যানিয়েলরা উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম মিলিয়ে তিনটে সফরে অজস্র ছবি এঁকেছিলেন। পথ অতি দুর্গম, ডাকাতির ভয়, পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল কারণ সরাসরি কোম্পানির শাসনাধীন এলাকা সামান্যই, যানবাহন বলতে নৌকো আর গরুর গাড়ি, ঘোড়া আর পালকি। কোনও জায়গায় পৌঁছে প্রচুর স্কেচ করতেন তাঁরা, প্রাচীন স্থাপত্যের খুঁটিনাটি ধরে রাখতে ব্যবহার করেছেন টেলিস্কোপ আর ক্যামেরা অবস্কিউরা। পরে স্কেচ থেকে আঁকতেন তৈলচিত্র। সে কালের কলকাতা ও মাদ্রাজে লটারির মাধ্যমে সেই সব তৈলচিত্র বিক্রি করে সফরের টাকা জোগাড় করেছেন। ১৭৯৪-তে লন্ডনে ফিরে প্রায় চোদ্দো বছরের শ্রমে প্রকাশ করলেন মোট ছ’খণ্ডে ১৪৪টি অ্যাকোয়াটিন্টের অসামান্য সম্ভার, ওরিয়েন্টাল সিনারি নামে যার বিশ্বজোড়া পরিচিতি।
কার্জন ছিলেন ড্যানিয়েল-প্রেমী, তাই মূলত তাঁর আগ্রহে এবং পরবর্তী কালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল-এ ওরিয়েন্টাল সিনারি-র দু’টি সেট ছাড়াও ড্যানিয়েলদের শতাধিক স্কেচ ও ৪৭টি তৈলচিত্র সংগৃহীত হয়। ওরিয়েন্টাল সিনারি থেকে বাছাই করা ৫৯টি অ্যাকোয়াটিন্ট নিয়ে ভিক্টোরিয়ার দরবার হল-এ শুরু হয়েছে প্রদর্শনী ‘ইন্ডিয়া ইন দি আইজ় অব টমাস অ্যান্ড উইলিয়াম ড্যানিয়েল’। চলবে মাসাধিককাল।
ইস্কুলে গান
সঙ্গীতকে স্কুল স্তরে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, এ নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা ওঠে ১৯১৩ সালে, মূলত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্যোগে। তৎকালীন ডিপিআই রবীন্দ্রনাথের (ছবি) কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি জানান শান্তিনিকেতনের কথা, গোড়া থেকেই যেখানে শিক্ষা ও যাপনেও গানের উপস্থিতি: উপাসনায়, নাটকে, বৈতালিকে। সবাইকে গায়ক হতে হবে না, কিন্তু সবার জীবনে গান থাকবে। শৌরীন্দ্রমোহনের মৃত্যু ও অন্যান্য কারণে তখন আর ব্যাপারটা এগোয়নি, ১৯২৮-এ ফের প্রস্তাব এলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, এ কাজের ভার দেওয়া যেতে পারে বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে বা গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়দের। তাতেও মুশকিল: কাগজে কাগজে প্রশ্ন ওঠে, বিষ্ণুপুর ঘরানাকে জাতে তুলতেই কি এত কিছু? বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষা ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলবেন অভ্র ঘোষ, ‘ইন্দিরা’ নিবেদিত ‘সুভাষ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’র নবম বর্ষে। আজ ৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দুমতী সভাগৃহে।
রথ ও যাত্রা
খুব বেশি আগের কথা নয়, রথের দিন চিৎপুরে কানে আসত সানাইয়ের সুর। চোখে পড়ত যাত্রা দলের গদিঘরের ব্যস্ততা। দুর্গাপূজা থেকে শুরু হওয়া যাত্রার নতুন মরসুমের পালার বায়না যে শুরু রথের দিন থেকেই! বায়নাদারদের জন্য থাকত খাবারের আয়োজন, ফেরার পথে হাতে মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার; নট-নটীদের একটু দেখার আশায় উদ্বেল হতেন মানুষ। যাত্রার জনপ্রিয়তা এখন ফিকে, তবু টিকে আছে গ্রাম-মফস্সলে। বাগবাজারে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সামনে গত ক’বছর ধরে রথের দিন স্টল সাজায় যাত্রার দলগুলি, থাকে নতুন পালার পোস্টার, প্রচারপুস্তিকা। পুরনো সে দিন না ফিরলেও, বায়না-খাতার উপর কলমের খসখসেই এই শিল্পের বেঁচে থাকার অক্সিজেন এখন।
স্মরণে
“আমাদের প্রজন্মের পরিচালকদের মধ্যে ও ছিল খুবই ‘ক্রিয়েটিভ’, অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক তো বটেই,” গৌতম ঘোষের মন্তব্য বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে। প্রয়াণের পর তিন বছর অতিক্রান্ত, এর মধ্যে তৈরি হয়েছে ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’, তাদের এবং ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস-এর যৌথ উদ্যোগে আজ নন্দন ৩-এ বিকেল ৪টেয় ‘সেলিব্রেটিং বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, মাস্টার অব সারিয়াল আর্ট’। থাকবেন গৌতম ঘোষ, অভিনেত্রী নৃত্যশিল্পী জয়া শীল ঘোষও। অসীম বসু বলবেন তাঁর ছবির দৃশ্যকল্পের ‘ম্যাজিক’ নিয়ে; বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রে লোকগান কী ভাবে তৈরি করে এক সমান্তরাল আখ্যানের বুনন, সেই নিয়ে বলবেন অভিজিৎ বসু। আর দেখানো হবে বুদ্ধদেবের ছবি, টোপ।
উৎসব-নাট্য
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক সওদাগরের নৌকা, অশোক মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় অভিনীত হয় ১৯৯৬-এ, থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর প্রযোজনায়। আটাশ বছর পরে আবারও তাঁরই নির্দেশনায় ফিরছে এ নাটক, আগামী ১০ জুলাই ‘নির্বাক অভিনয় অ্যাকাডেমি’র প্রযোজনায়। থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর ৫৮ বছরে অ্যাকাডেমি মঞ্চে তিন দিনের নাট্যোৎসব ১০-১২ জুলাই রোজ সন্ধ্যায়। ১১ জুলাই সুমন সেনগুপ্তের নির্দেশনায় সত্যেন মিত্র পুরস্কারজয়ী নাটক আমার গান, এ নাটকের জন্য বর্ষশ্রেষ্ঠ নাট্যকারের পুরস্কারে ভূষিত তিনি। ১২ জুলাই থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর গ্রেট বেঙ্গল থিয়েটার, রচনা ও নির্দেশনায় সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পঁচাশিতে পা দেওয়া অশোক মুখোপাধ্যায় এ নাটকে মুখ্য ভূমিকায়।
অথ বঙ্গ-কথা
পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলোচনা, জার্মানিতে? কথা হল, শুধু জার্মানি কেন, পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা এখন বহু বিদেশি আলোচনাসভার ফার্স্ট বেঞ্চে জায়গা করে নিচ্ছে। শুধু এ বারের ভোটে রাজ্যের অবদানের জন্যই নয়, অন্য কারণেও। দুর্নীতি বা জনমোহিনী রাজনীতির জন্য। সংখ্যাগুরু-আগ্রাসন রোধের জন্যও। ইউনিভার্সিটি অব গোটিংগেন সারস্বত মানচিত্রে উজ্জ্বল— সেখানেই পর পর দু’বছর জুনে বসল বঙ্গবিদ্যার আসর ‘মেটামরফসিস অব বেঙ্গল পলিটিক্স’। রাষ্ট্রতাত্ত্বিক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ও শ্রীরূপা রায়ের আয়োজনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাস অর্থনীতি নৃতত্ব সমাজতত্ত্বের যে আলোচকরা এলেন তাঁরা সবাই বাঙালি নন, এমনকি নন ভারতীয়ও। দেখেশুনে মনে হল, ভালমন্দ যা-ই হোক, ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে’ সেটা মন দিয়ে শোনা দরকার, অনুসরণ-অনুকরণ করতে হলেও, পরিত্যাগ বা বিনাশ করতে হলেও।
মেটিয়াবুরুজে
এই শহরে ছিলেন তিন দশকেরও বেশি সময়, সংস্কৃতির নানা দিকে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা সমৃদ্ধ করেছিল কলকাতাকে। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের মৃত্যুর পর মেটিয়াবুরুজের সৌধগুলি ক্রমে পরিণত হল কারখানার ঘিঞ্জি আবাসে, তাঁর উত্তরাধিকার বলতে এখন শুধু বিরিয়ানির কথাই মনে পড়ে! আজ মেটিয়াবুরুজের গলিঘুঁজিতে নবাবি ছোটা লখনউ-এর সংস্কৃতিচিহ্ন, বিশেষত তাঁর প্রিয় কত্থক নৃত্যচর্চা খুঁজতে গেলে কেমন হবে? উত্তর খুঁজেছেন কত্থক নৃত্যশিল্পী-গবেষক শ্রুতি ঘোষ। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দি আর্টস (আইএফএ)-র এক প্রকল্পে গবেষণাসূত্রে ঘুরেছেন এই এলাকা, কথা বলেছেন, ডুব দিয়েছেন প্রাসঙ্গিক বই-নথি ও এ বিষয়ে আগের শিল্পীদের কাজে। তারই নির্যাস মাল্টিমিডিয়া প্রদর্শনী ‘মুলাকাত মেটিয়াব্রুজ সে’। মেটিয়াবুরুজ কাচ্চি সড়ক রোডে গার্ডেন প্লাজ়ায় দেখা যাবে আগামী ৯ থেকে ১১ জুলাই, বিকেল ৪টা-রাত ৮টা। ছবিতে নাচের সঙ্গতে নবাব।
বৈঠকি সেতার
বর্ষার জলতরঙ্গ বাজছে, প্রকৃতির অবারিত কনসার্ট। এ সময়ে ঘরে বসে মেঘ-মল্লারের রসাস্বাদনই মনে ধরে, তা বলে কি বৈঠক হবে না? ডিএজি মিউজ়িয়মস-এর উদ্যোগে সেই আয়োজন এ বার শহরে, উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে রামদুলাল নিবাসে। ‘ইন্টারসেকশনস: মিউজ়িক’ শিরোনামে একগুচ্ছ অনুষ্ঠান করে আসছে এই শিল্প সংগ্রহশালা ও শিল্পচর্চা প্রতিষ্ঠান, তারই অঙ্গ এই ‘দ্য স্টোরি অব দ্য সেতার’— চলচ্চিত্র প্রদর্শন, শিল্পীদের কথালাপ এবং অবশ্যই সেতার-বাদন। আজ বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলবে এই বৈঠক, থাকবেন এটাওয়া ঘরানার সেতারশিল্পী, উস্তাদ শাহিদ পারভেজের শিষ্য শুভ্রনীল সরকার; সেতার পরিবেশনের পাশাপাশি বলবেন তার নির্মাণশিল্প নিয়েও। তবলা সঙ্গতে ফারুখাবাদ ঘরানার শিল্পী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি অনুষ্ঠানের প্রচারপত্র থেকে।
আপসহীন
গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক স্তরে স্বর্ণপদক; পরবর্তী কালে যশস্বী শিক্ষক হয়েছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী। রাজ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ওয়েবকুটা-র সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন, অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অব ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ টিচারস অর্গানাইজ়েশন গঠনেও ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। অস্থির সত্তরের দশকে যোগ দেন রাজনীতিতেও, ভোটে জিতে ষষ্ঠ লোকসভায় ছিলেন কলকাতা দক্ষিণের প্রতিনিধি। ’৭১-এ ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ গঠনে তাঁর অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ভূষিত করে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায়। শিক্ষকদের অধিকারের লড়াইয়ে আপসহীন এই মানুষটির জন্মশতবর্ষ উদ্যাপিত হল গত ২৮ জুন, রোটারি সদনে। স্মৃতিচারণায় ছিলেন তাঁর একদা-সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী ও বিশিষ্টজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy