শীতের আমেজ কেটে গিয়ে ক্রমশ বাড়ছে তাপমাত্রা। কিছু দিনের মধ্যে প্রবল গরমে হাঁসফাঁস করার ফাঁকেই কথোপকথনে উঠে আসবে বিশ্ব উষ্ণায়ন, গাছ কাটার কুফল, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলি। এগুলি নিয়ে বহু আলাপ-আলোচনা হলেও অনেকেই বুঝতে পারি না যে, পরিবেশবান্ধব হওয়ার কাজটা আমরা শুরু করতে পারি নিজেদের বাড়ি থেকেই। মানুষের বিভিন্ন কাজের জন্য যে পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হয়, তাকে বলা হয় ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’। আর এই ‘কার্বন ফুটপ্রিন্টের’ সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের। প্রতিটি মানুষের জীবনযাত্রার ধরনের উপরে নির্ভর করে ফুটপ্রিন্টের হার। তাই পরিবেশ সচেতনতার প্রথম পাঠই হল ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’ কমানো।
এর জন্য জল ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো, বর্জ্য উৎপাদন কমানো, পরিবেশবান্ধব যানের ব্যবহার, জিনিস পুনর্ব্যবহারের মতো সাধারণ কিছু কাজ করতে পারেন যে কেউই। তবে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য, পলিয়েস্টারের পোশাক, এক বার ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহারের প্রবণতা যখন বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন কী ভাবে কমানো যাবে ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’? তার হদিস দিচ্ছে এই শহরের কিছু বিপণি, যাদের মূল মন্ত্রই হল পরিবেশ সচেতনতা। পরিবেশবান্ধব উপায়ে জিনিস উৎপাদন, কোনও জিনিস পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য কমানো এবং সামগ্রিক ভাবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোই এই বিপণিগুলির লক্ষ্য।
কয়েক বছর ধরেই পরিবেশবান্ধব পোশাক, খাবার, ঘর সাজানোর জিনিস ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে পরিচিতি লাভ করেছে দক্ষিণ কলকাতার বিপণি ‘দেশজ’ স্টোর ও ক্যাফে। একটি পোশাক বানাতে কাঁচামাল ছাড়াও প্রয়োজন হয় প্রচুর জলের। তাই দেশজের লক্ষ্য ‘স্লো ফ্যাশন’— অর্থাৎ, এমন পোশাক তৈরি করা যা প্রাকৃতিক সুতো ও রঙের ব্যবহারে তৈরি এবং দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা যাবে। বিপণিটির অন্যতম কর্ণধার সোনালি চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, অবিক্রীত পোশাক ফেলে না দিয়ে তাঁরা সেটি বিভিন্ন ভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলেন, যাতে সেটি তৈরির পরিশ্রম ও কাঁচামাল নষ্ট না হয়। আর এই পোশাক তৈরি করেন গ্রামীণ মহিলারা। ফলে তাঁদের স্বনির্ভর হওয়ারও দিশা জুগিয়েছে এই কাজ।
সোনালি বলেন, ‘‘কোভিড অতিমারির পর থেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে তারকা, সকলেই পোশাক বা অন্য জিনিস এক বারের বদলে বার বার ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেছেন। প্রকৃত হাতে বোনা, অর্গ্যানিক সুতি, অর্গ্যানিক খাবার ব্যবহারের ঝোঁক বাড়ছে।’’
কোভিডের প্রভাবই এই সচেতন জীবনযাত্রার দিকে ঠেলে দিয়েছে প্রাক্তন জনসংযোগ কর্মী সোমিনী সেন দুয়াকে। তখন থেকেই বাড়িতে আনাজ-ফলের খোসা পচিয়ে জৈব সার তৈরি, তার ব্যবহারে ছাদে জৈব পদ্ধতিতে আনাজ ফলানো শুরু করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি, শুরু করেন ‘মৃত্তিকা আর্থি টকস’ নামে একটি পরিবেশ-সচেতনতা মূলক সংগঠনও। কৃত্রিম সুতোর পোশাক বর্জন থেকে শুরু করে নানা ভাবে ‘লো কার্বন’ জীবনযাপন করা সোমিনীর উদ্যোগে সম্প্রতি বালিগঞ্জে পথ চলা শুরু করেছে ‘মৃত্তিকা আর্থি টকস’-এর নতুন বিপণি। যা সেজে উঠেছে পরিবেশ সচেতনতা এবং পুনর্ব্যবহারের মন্ত্রেই। পুরনো শাড়ি, পর্দা থেকে তৈরি ব্যাগ, টেবল রানার কোস্টার, বাঁশের তৈরি টুথব্রাশ, গোবর থেকে তৈরি ধূপ এবং মশা তাড়ানোর ধূপ, নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস মিলবে সেখানে। এ ছাড়াও, অর্গ্যানিক ঘি, মধু, ঘরে তৈরি আচার, সাবান, উপহারেরও সম্ভার রয়েছে সেখানে।
সোমিনী বলেন, ‘‘কোভিডের সময় থেকেই আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে বড়সড় বদল আসে। বুঝতে পারি, পরিবেশকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। এই ভাবনা থেকেই নিউ টাউনের একটি জমিতে জাপানি মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে একটা ছোট অরণ্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করি। ইতিমধ্যেই প্রায় ৮০০টি গাছ বসানো হয়েছে।’’
তবে প্রশ্ন ওঠে, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটা বৃহৎ সমস্যার সামনে কেবল ব্যক্তিগত সচেতনতা কতটা সাহায্য করবে? ‘‘রাষ্ট্র যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না, তা নয়। খাদি, অর্গ্যানিক খাবার নিয়ে কাজ করছে রাজ্য ও কেন্দ্রও। কিন্তু সব দায়িত্বই তো সরকারের নয়। প্রতিটি মানুষ এটা নিয়ে ভাবলে তবেই সুফল মিলবে। পরিবেশবান্ধব জিনিসের চাহিদা বাড়লে, উৎপাদন বেশি হলে সেই সব জিনিসের দাম কমানোরও একটা সুযোগ থাকবে।’’— আশাবাদী শোনায় সোনালির গলা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)