‘নবনীতা দেবসেন স্মারক বক্তৃতা’ মঞ্চে অমর্ত্য সেন। পাশে শঙ্খ ঘোষ। ছবি: রণজিৎ নন্দী
প্রথমে নাম দিয়েছিলেন ‘স্বদেশ ও বিদেশ’। পরে তা বদল করে, ‘বিরোধী যুক্তি’। প্রয়াণের পরে নবনীতা দেবসেনের প্রথম জন্মদিনে প্রথম স্মারক বক্তৃতার শিরোনামে এই বদলটুকুর মধ্যেই কি একটি পরিক্রমা ছিল? সোম-সন্ধ্যায় কানায় কানায় ভরা রবীন্দ্রসদনে অমর্ত্য সেনের বক্তৃতা শোনার পরে এ প্রশ্ন গুঞ্জরিত হল শ্রোতাদের অনেকের মনেই।
মহাকাব্যের মৌখিক রূপ ও ভেদ এবং স্বদেশের রবীন্দ্রনাথ বিদেশের মাটিতে কতটা কী ভাবে আলাদা, কেনই বা আলাদা— নবনীতার লেখার সূত্র ধরে এই দু’টি বিষয়কে এ দিন সামনে রাখলেন অমর্ত্য। সেই পর্যালোচনার মধ্য থেকে নিষ্কাশন করে আনলেন, দু’টি বার্তা— বিরোধিতা মানে কলহ নয়। বরং যুক্তিপূর্ণ বিরোধিতার দ্বান্দ্বিক চরিত্র থেকেই বেরিয়ে আসে উদ্ভাবন আর সৃষ্টির নতুন পথ। কিন্তু বিরোধিতাকে সেই সৃষ্টিশীল ভূমিকায় উপনীত হতে গেলে, যে বিষয়ে বিরোধিতা, সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং সমঝদারি থাকা দরকার। আর সেটা যদি থাকে, বিরোধিতা যদি ন্যায্য হয়, তা হলে তথাকথিত ‘বিরোধী ঐক্য’ থাক বা না থাক, বিরোধিতা এবং প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়া জরুরি।
নবনীতার লেখায় অমর্ত্য এবং তাঁদের দাম্পত্যজীবনের টুকরো ছবি বারবারই এসেছে। সেই নবনীতার স্মরণে বক্তৃতা অমর্ত্য শুরু করলেন পুরনো স্মৃতি উস্কে— সে বার নবনীতা বাড়ি না থাকায় নাছোড় কবির একগাদা কবিতা শুনতে হয়েছিল অমর্ত্যকে। বলার চেষ্টা করেছিলেন, কবিতা বিষয়ে তিনি ‘জ্ঞানবুদ্ধিহীন’। উত্তর এসেছিল, ‘জ্ঞানবুদ্ধিহীন’ লোকেদের কাছে তাঁর কবিতা কেমন লাগে, সেটা জানতেও কবি সমান আগ্রহী!
আরও পড়ুন: বৈষম্য-শুনানি নিয়ে বৈঠকের নির্দেশ কোর্টের
এই গল্পটি অমর্ত্য শোনান, এ কথা বলে নিয়েই যে, তাঁর এবং নবনীতার কাজের ক্ষেত্র এক ছিল না। কিন্তু তাঁর এ দিনের বক্তব্যের বিস্তারে তিনি সূত্রগুলি ব্যবহার করলেন মূলত নবনীতারই গবেষণা থেকে। চিন্ময় গুহ, শ্রীজাতদের স্মৃতিচারণার পরে তখন মঞ্চে প্রধান অতিথি শঙ্খ ঘোষ, সভাপতি সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অমর্ত্যর এ দিনের বক্তৃতা এবং তৎপরবর্তী প্রশ্নোত্তরের আসরে কলকাতা শুনল গবেষক নবনীতার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য। প্রতিবাদের ঝড়ে উথালপাথাল এই সময়ে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ যেন ধরিয়ে দিলেন, বিরোধী যুক্তিকে কী ভাবে দাঁড়াতে হবে শক্ত মাটিতে। মস্তিষ্কহীন হৃদয়াবেগ নয়, চাই বিষয়ের উপরে দখল। মধুসূদন দত্ত বাল্মীকি রামায়ণের বিরোধী ভাষ্য লিখতে পারেন বাল্মীকিকে আত্মস্থ করে তবেই। নবনীতার রামায়ণ-গবেষণাও তা-ই। কোনখানে বিরোধিতা, কোন প্রশ্নে বিরোধিতা, ঘাটতি যেন না থাকে বোঝাপড়ায়।
অথচ বোঝাপড়ার প্রক্রিয়াটি জটিল। নবনীতার লেখা থেকে সূত্র টেনেই অমর্ত্য উত্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথের কথা। বিশ শতকের প্রথম দু’দশক যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পশ্চিমি দুনিয়া উচ্ছ্বসিত ছিল, কিছু দিন পর থেকে তারাই উৎসাহ হারাল। কেন? নবনীতা দেখিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের লেখার যতটা যে ভাবে বিদেশিদের কাছে পৌঁছচ্ছিল, গন্ডগোলটা সেখানে। রবীন্দ্রনাথকে একটা সময়ের পরে প্রাচ্য মহামুনি ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি তাদের। অথচ সেই রবীন্দ্রনাথই স্বদেশে তখন ক্রমশ আরও তীক্ষ্ণ হচ্ছেন। অমর্ত্য বললেন, স্বদেশ ও বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তির এই ফারাকটা রবীন্দ্রনাথও জানতেন। কিন্তু সে সময়ে তিনি ভেবেছিলেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনে সেটা কার্যকরীই হবে। বাস্তবে তা হয়নি।
অতএব অমর্ত্যর সতর্কবাণী, ‘হিতের প্রচেষ্টায় অহিতের জন্ম’ হতে পারে, আবার সেই ভুলের পিছনে থাকতে পারে অন্যতর যুক্তি। বিরোধিতার যুক্তি-সন্ধান এই জটিলতাকে বাদ দিয়ে নয়। কিন্তু দৃষ্টি যদি স্বচ্ছ থাকে, তা হলে এক শাখার জ্ঞান কাজে লাগে অন্য শাখায়। হোমারকে নিয়ে গবেষণা যেমন রামায়ণে কাজে লাগে, তেমনই বঞ্চনাকে বোঝার প্রশ্নে নারীবাদের শিক্ষা কাজে আসে বিশ্বায়নের অন্তর্গত বৈষম্যকে বুঝতেও।
এক সময় ‘ফেমিনিস্ট ইকনমিক্স’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে নাম থাকত অমর্ত্যর। বললেন, ‘‘আমার নামটা ‘ওয়াই এ’ দিয়ে শেষ হওয়ায় অনেকেই চিঠি লিখতেন, ডিয়ার মিস সেন বলে!’’ আর সেই নাছোড় কবি? তাঁর নামটা জানতে পারি কি? প্রশ্ন করলেন একজন। ‘‘জানতে পারেন না’’, সপাট জবাব সহাস্য অমর্ত্যর। তাঁর মুখ থেকে সেই হাসি তখন ছড়িয়ে গিয়েছে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy