পাড়ায় সে ছিল নিতান্তই মুখচোরা, লাজুক স্বভাবের। সে ভাবে মেলামেশা ছিল না কারও সঙ্গেই। রোজ তাকে শুধু দেখা যেত স্কুলে যাওয়ার এবং আসার সময়ে। পাড়ার দোকানে কখনও গেলে জিনিস কিনেই সোজা বাড়ি চলে আসত সে। বছর ষোলোর সেই শান্তশিষ্ট কিশোরই যে শহরের বুকে ভরসন্ধ্যায় এমন এক ভয়াবহ খুনের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে, তা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না বিস্ময়ে হতবাক প্রতিবেশীরা।
পড়শিরা শুনেছেন, বাবার বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জেরেই নাকি এক তরুণীকে কুপিয়ে খুন করেছে ওই কিশোর। শুক্রবার মধ্য কলকাতায় ওই পরিবারের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, দরজায় তালা ঝুলছে। উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দা জানালেন, ওই কিশোরের তিন বোন। বড় জন সপ্তম শ্রেণিতে ও মেজো জন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটটির দেড় বছর বয়স। প্রতিবেশীদের প্রশ্ন, এই ঘটনায় ওই নাবালক জড়িয়ে পড়ল কী ভাবে? কেউ কি তাকে এই কাজ করতে উস্কেছে? সে ছুরি পেল কোথায়? কেন তার মধ্যে এতটা আক্রোশ জন্মাল?
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের মতে, ‘‘প্রতিবেশীদের নজরে না এলেও ওই কিশোরের মধ্যে হিংসার একটা বীজ হয়তো লুকিয়ে ছিল। যা সম্ভবত তৈরি হয়েছিল তার পারিপার্শ্বিক আবহ থেকেই। বহু বছর ধরেই হয়তো বাড়িতে সুস্থ পরিবেশ ছিল না। ছোটবেলাতেও সম্ভবত ছেলেটি বাড়িতে হিংসার পরিবেশ দেখেছে। মা-বাবার ঝগড়া শুধু নয়, মা ও বাবাকে কেন্দ্র করে আরও কিছু ঘটনা তার মনে দাগ কেটে থাকতে পারে। তা থেকেই হয়তো এই রাগের বহিঃপ্রকাশ। সে কারও উস্কানিতে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, এটা ভাবা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।’’ অনিরুদ্ধের মতে, আজকাল খুন-জখমের ঘটনা এত বেশি চোখে পড়ছে যে, এই ধরনের ঘটনাও কাউকে কাউকে ততটা স্পর্শ করছে না। তিনি বলেন, ‘‘বাইপাসের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাবে। অন্য নাবালকেরাও জানবে, পড়বে। তাদের বোঝাতে হবে, এমন ঘটনা কখনওই কাম্য নয়। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করাতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়িতে তাদের সুস্থ পরিবেশও দিতে হবে।’’
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট প্রশান্ত রায় বলছেন, ‘‘হিংসাত্মক হওয়ার প্রবণতা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে। আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি। সেই কাজ করে আমাদের কপালের পিছনে থাকা প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেটিরও বিকাশ ঘটে। ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের বিকাশ হয়। মস্তিষ্কের বাকি অংশের বিকাশ আগে হলেও ওই অংশটির বিকাশ হতে ২৫ বছর লেগে যায়। বয়ঃসন্ধিকালে অনেকেই খুব আবেগপ্রবণ হয়। দীর্ঘদিন ধরে কোনও তীব্র আবেগের ধারাবাহিক ঘটনার জেরে উত্তেজিত অবস্থা তৈরি হলে পুরোপুরি বিকশিত না হওয়া প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স বা কন্ট্রোল নেটওয়ার্কে সমস্যা তৈরি হয়। তখন যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চলে যায়। কিশোর বা কিশোরীদের এমন হিংসাত্মক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার উদাহরণ অতীতেও দেখা গিয়েছে।’’
প্রশান্তের মতে, ‘‘কারও যদি এমন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর ইতিহাস না-ও থাকে, তা হলেও সে এমন কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তবে, এর পিছনে ওই কিশোরের বাড়ির লোকের কতটা মদত ছিল, তা-ও দেখতে হবে। কারণ, ওই কিশোরের সঙ্গে যে ছুরি ছিল, তা বাড়ির লোক জানত না, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)