Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
SFI

ভাইয়ের মুখটা বার বার ভেসে উঠছে দিদির সামনে

ভাইয়ের ছবি কোথাও রাখা নেই ফ্ল্যাটে। দিদি নিষেধ করেছেন, ‘‘প্লিজ়, ওর ছবি টাঙিয়ো না। চোখের সামনে ওই মুখ সারা ক্ষণ দেখতে পারব না।’’

 সুদীপ্তের স্মৃতিচারণায় তাঁর দিদি।

সুদীপ্তের স্মৃতিচারণায় তাঁর দিদি। নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:৪৪
Share: Save:

ভাইয়ের ছবি কোথাও রাখা নেই ফ্ল্যাটে। দিদি নিষেধ করেছেন, ‘‘প্লিজ়, ওর ছবি টাঙিয়ো না। চোখের সামনে ওই মুখ সারা ক্ষণ দেখতে পারব না।’’

গড়িয়া স্টেশনের কাছে শ্রীনগর গমকল গলিতে কাছেই সুমিতা সেনগুপ্তের বাপের বাড়ি। পাড়ার লোকের মুখে ‘সুদীপ্ত গুপ্তের বাড়ি’। এখনও। আট বছর বাদেও। একুশ বছরের তরতাজা তরুণের নিষ্পাপ মুখটা সোমবার ফের ভেসে উঠছে পাড়াপড়শির চোখে। রাজনৈতিক আন্দোলন করতে গিয়ে এ শহরে নিহত আর এক তরুণ মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যুর অভিঘাতে।

সুদীপ্তের বাবা সত্তরোর্ধ্ব প্রণব গুপ্ত নানা স্নায়বিক জটিলতায় কাবু হয়ে এখন হাসপাতাল-ফেরত বৃদ্ধাবাসের আবাসিক। তেতলা বাড়িটা খাঁ খাঁ করবে? ভেবে সুমিতা এক বার ঠিক করেন, ওখানে থাকবেন। পারেননি। মা আর ভাইকে নিয়ে কানায় কানায় ভরপুর সুখস্মৃতিগুলো তখন তাড়া করছিল। ‘‘পার্থ (সুদীপ্তের ডাকনাম) আমার থেকে দশ বছরের ছোট। কোলেপিঠে মানুষ। অত ছোট ভাই কি পেটের ছেলের থেকে আলাদা, বলুন?’’ সোমবার বিকেলে গমকলের গলিতে চিলতে ফ্ল্যাটে বসে বলছিলেন, ২০১৩ সালে রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে ‘দুর্ঘটনা’য় নিহত এসএফআই কর্মী সুদীপ্ত গুপ্তের দিদি সুমিতা। পিঠের একটা ব্যথা খুব ভোগাচ্ছে। রাজ্য-রাজনীতির আর একটি উত্তাল দিনে বাড়িতে আসা আগন্তুকের উপস্থিতিতে সোজা হয়ে উঠে বসেছেন।

সন্ধ্যার মুখে খুঁজে খুঁজে হাজির হওয়ার সময়ে ফ্ল্যাটটা অন্ধকার। ‘‘মা ভাল নেই! টিভি বন্ধ করে শুয়ে রয়েছেন’’, সুদীপ্তের ভাগ্নে দরজা খুলে বলছিলেন। বারো ক্লাসের ১৮ ছুঁই ছুঁই তরুণের চোখমুখে তাঁর ‘মামাভাই’য়ের (সুদীপ্ত) মুখের ছাপ। বার কয়েকের অনুরোধে মাকে ডেকে দিলেন সেই তরুণ। সুদীপ্তের দিদি বলছিলেন, ‘‘কিছু ক্ষণ টিভিটা খুলেছিলাম। দেখলাম আন্দোলন, বিক্ষোভ চলছে। তলায় বড় হরফে লেখাটা বেরিয়ে যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী টাকা দেবেন। টাকা! টিভি বন্ধ করে দিয়েছি।’’ ম্লান হাসি ফুটে ওঠে দিদির চোখে।

শোকার্ত: ২০১৩-এ সুদীপ্তের ছবি নিয়ে মিছিল।

শোকার্ত: ২০১৩-এ সুদীপ্তের ছবি নিয়ে মিছিল। ফাইল ছবি।

রাজনীতির মারপ্যাঁচ, বিভিন্ন দলের ভালমন্দ এ সব বোঝেন না সুদীপ্তের দিদি। তবে এটা বোঝেন, ২০২১-এ দাঁড়িয়ে রাজনীতি ঢের জটিল হয়েছে। সুমিতা বলেন, ‘‘ভাইটা চলে যেতে সব দলের লোকই এসেছিল। সুজনদা (চক্রবর্তী), সূর্যকান্ত মিশ্র তো খুবই আসতেন! কে জানে, বিজেপি-র কেউ এসেছিল কি না! তখন তো ওরা প্রায় ছিল না।’’ ভাইয়ের মৃত্যুতে ‘বিচার’ না-পাওয়ার ক্ষত আর খোঁচাতে চান না সুমিতার দিদি। আর একটি পরিবার ধসিয়ে দেওয়া মৃত্যুর যন্ত্রণা তবু সেই জ্বালাই উসকে দেয়।

সুমিতা বলেন, ‘‘একটা ঘটনা কী ভাবে গোটা পরিবার, সবার জীবন তছনছ করে দিতে পারে তা আমিই জানি। বাবার অসুস্থতা, ভেঙে পড়া তো আছেই! আমিও অবসাদের জন্য ওষুধ খাই। চিকিৎসা চলছে। আমার স্বামী (সুজিত সেনগুপ্ত), ছেলে বোঝে এই কষ্ট।’’ সুদীপ্তের মা চলে গিয়েছিলেন ছেলের মৃত্যুর বছরখানেক আগে। ছেলে ‘পার্টি’ করে বলে গর্বই ছিল মায়ের। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দিয়ে হোলটাইমার হয়ে গেল! এখন সুমিতা বলেন, ‘‘মা মরে গিয়ে বেঁচেছেন! ছেলে চলে যাওয়ার শোক সহ্য করতে হয়নি।’’

মায়ের নির্দেশে পুত্র (সুদীপ্তের ভাগ্নে) চা করতে গিয়েছিলেন। সুমিতা বলেন, ‘‘আমার ভাইয়ের বন্ধুরা এখনও অনেকেই রাজনীতিতে। কিন্তু আমার বাড়ির কেউ মিছিল, মিটিং করবে ওই টেনশন এখনও সহ্য করার অবস্থায় নেই আমি। কী লাভ হয় বলুন! ওই যে বলে না, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’’ রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে চান না সুমিতার পুত্র। সুমিতা বলে ওঠেন, ‘‘ওকে
ও-সব জিজ্ঞেস করবেন না। এখন ওর দিকে তাকিয়েই আমি বাঁচি! ওর মুখটায় ভাইয়ের মুখ বসানো।’’ গলাটা বুজে আসে! ‘‘আমার ছেলের একুশ বছর বয়সটা যে কবে পেরোবে!’’ ভাইকে এখন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন দিদি।

অন্য বিষয়গুলি:

SFI
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy