অসুরদলনী: হাটখোলা দত্তবাড়ির ঠাকুরদালানে তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র
স্রেফ পুজোমণ্ডপ জীবাণুমুক্ত করে বা স্যানিটাইজ়েশন টানেল বসিয়েই ভাইরাসকে ঠেকানো যাবে না! এ কথা সার বুঝেছেন ওঁরা। মণ্ডপ প্রাঙ্গণ বা ঠাকুরদালানে পারস্পরিক দূরত্ব রাখলেও এটা গোটা শহরের নিরাপত্তার প্রশ্ন। তা মাথায় রেখেই ঠিক হচ্ছে, দুর্গাপুজো কী ভাবে সারা হবে।
পরম্পরা ও সুরক্ষার দ্বন্দ্বে যেমন কঠোর হওয়ার পথেই হাঁটা হবে বলে ঠিক করেছে শোভাবাজার রাজবাড়ি। ‘‘ভক্তদের দূরে রেখে শুধু সেবায়েত দিয়ে যদি পুরীর রথ টানা সম্ভব হয়, তা হলে আমাদের পুজোই বা কেন দর্শনার্থীদের বাদ দিয়ে সারা যাবে না? লোকে ঠাকুর দেখতে না-পারলে কষ্ট হবে ঠিকই! তবু সকলের সুরক্ষায় এ ছাড়া উপায় নেই।’’— বলছেন শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রবীণ কর্তা অলোককৃষ্ণ দেব। মিটিং ডেকে পরিবারের সব মাথারা একযোগে লিখিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাতে ঠিক হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের সবাই এ বার ছাপানো পরিচয়পত্র হাতে ঢুকবেন। কোনও অতিথি, বন্ধুর জন্য সামান্য ক’টা পরিচয়পত্র থাকবে।
রাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুত্র রাজকৃষ্ণের উত্তরপুরুষদের এই পুজোটি হয় গোপীনাথ ভবনে। চলছে ২৩১ বছর। আর পলাশির যুদ্ধের পরে নবকৃষ্ণ দেবের নিজের পুজো হয় উল্টো দিকে প্রশস্ত ‘বাগওলা বাড়ি’র দালানে। কলকাতার নানা বড়বাড়ির মধ্যে এই দু’টি পুজোর জৌলুস ঘিরে জনসাধারণের আগ্রহ এখনও প্রবল। এ বার বেশ কয়েকটি বড়বাড়িতেই কারও না কারও উপরে কোভিডের ছায়া পড়েছে। তাই সতর্কতার পাল্লা ভারী। বাগওলা বাড়ির বৌমা সলমা দেব (প্রয়াত রথীন্দ্রনারায়ণ দেবের পুত্রবধূ) অবশ্য জানাচ্ছেন, পুজোয় দর্শনার্থীদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তবে নানা বিধিনিষেধ থাকবে। বস্তুত, বাড়ির সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব রেখে মিলনমেলার কাজটাও কঠিন বলে তাঁরা টের পাচ্ছেন।
বাদশা জাহাঙ্গিরের আমলের পুজো বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের মা দুর্গাকে নিয়েও বিস্তর চিন্তা এ বার। শহর জুড়ে তাঁদের আটটা বাড়িতে যতটা সম্ভব অনাড়ম্বরেই তা সারা হবে। বড়বাড়ির পুজোটিই যেমন শামিয়ানা খাটিয়ে আতিশয্যের বদলে পাশের অন্নপূর্ণা মন্দিরে ঢুকে পড়ছে। পুজোকর্তা দেবর্ষি রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘ঠাকুরও ছোট করছি। মুখে বিধিনিষেধের ঘোষণা করব না। তবে পুজোটা কোনও প্রচার ছাড়া নিচু তারে বাঁধা থাকবে। এ বছর এটাই উচিত।’’
কোভিড পরিস্থিতিতে নিয়মরক্ষার ঘটপুজো করছেন ভবানীপুরের গিরিশ ভবনের মুখোপাধ্যায়রাও। হাটখোলার দত্তবাড়ির ২২৭ বছরের পুজোর কর্তা আস্তিক দত্তেরও তেমনই ইচ্ছে ছিল। সবার চাপে পুজো হলেও প্রতি বারের ভূরিভোজ, জনসমাগম এ বার বন্ধ। বাগবাজারের হালদারবাড়িতে সাড়ে চারশো বছর ধরে নিত্যপুজোপ্রাপ্ত কষ্টিপাথরের মহিষমর্দিনীই পুজো পান। তাঁর বিসর্জন নেই। তবু প্রধান সেবায়েত দেবাশিস হালদার, পুজোকর্তা পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়েরা ঠিক করেছেন, দফায় দফায় দালান স্যানিটাইজ় করা হবে। পুজো হবে সীমিত সংখ্যক ফুল দিয়ে। কলাবৌ স্নানের বর্ণাঢ্য মিছিল কার্যত বাতিল। দূরত্ব-বিধি মানা হবে কুমারীপুজোয়। সাবেক বন্দুকের দোকান-খ্যাত জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়িও ঠাকুরের মাপ ছোট করছে, যাতে ভাসানে কম লোক লাগে।
পর্যটকদের নিয়ে সাবেক কলকাতার বড়বাড়ি সফরের আয়োজন করেন নবপ্রীত অরোরা। এ বছর তিনি সে সব বন্ধ রাখছেন। শোভাবাজারের কর্তারা এ বার ঢাকি, সানাইবিহীন পুজোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হয়তো রেকর্ডিং বাজবে। পুজোয় ছাগবলির জল্লাদের আসাও অনিশ্চিত। তবে পরম্পরায় ছেদ পড়লেও পুজোর সঙ্গে জড়িত কাউকে প্রাপ্য দক্ষিণা থেকে বঞ্চিত করতে চান না বড়বাড়ির কর্তারা। চোরবাগানের মিত্তিরবাড়িও মনে করে, বছরটা আড়ম্বরের নয়। বরং সংযম ও সতর্কতার।
সঙ্কটে পুজোপাগলদের এই বার্তাটুকু দিতে চান শহরের বনেদি কুলপতিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy