আবার এসো: দশমীর বিকেলে বিষাদের সুর। বাগবাজার ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন। ছবি: সুমন বল্লভ
বাবুঘাটের উল্টো দিকের ফুটপাতে বসে আক্ষেপ করছিলেন বছর পঁচিশের যুবক। সঙ্গীদের বলছিলেন, ‘‘ধুর! এখনও একটাও বিক্রি হল না।’’
প্রতি বছর বাজে কদমতলা ঘাটের সামনে ঘুরে সাপ বেলুন আর ভেঁপু বিক্রি করেন পাপ্পু শেখ। সোমবার বিজয়া দশমীতে অন্য বিক্রেতাদের সঙ্গে দুপুরে তিনিও চলে এসেছিলেন। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও ১০ টাকা দামের সরু লম্বা পাইপের মতো দেখতে বেলুন বিক্রি না হওয়ায় বেজায় মন খারাপ তাঁর। আর এক বিক্রেতা বাপির কথায়, ‘‘পুলিশ তো এ বারে ব্যারিকেডের ভিতরে ঢুকতেই দিচ্ছে না।’’
প্রতি বছর প্রতিমা বিসর্জনের পরে লরিতে চেপে দুই হাতে ওই লম্বা বেলুন ধরে, ভেঁপু বাজিয়ে ফিরতে দেখা যায় পুজো কমিটির পুরুষ-মহিলা ও শিশুদের। এ দিন বাবুঘাটের মঞ্চ থেকে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল মহিলা ও শিশুদের বিসর্জনের ঘাটে ঢোকা নিষেধ। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে তাই অধিকাংশ পুজো কমিটিই এ দিন প্রতিমা বিসর্জনে মহিলা ও শিশুদের নিয়ে আসেনি। তবে কয়েকটি পুজো কমিটির সঙ্গে গুটি কয়েক মহিলা-বাচ্চা এলেও তাঁরা বাবুঘাটের বাইরেই থেকেছেন। বাজে কদমতলা ঘাটে ঢোকার মুখে এ দিন পুলিশের লক গেট ছিল। মোটবাহকেরা প্রতিমা নিয়ে ভিতরে ঢোকার পরে তিন-চার জন কমিটির সদস্য ছাড়া বাকিদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন: রাজ্যে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী, আশা জাগিয়ে সামান্য বাড়ল সুস্থতার হার
তবে ঘাটের বাইরে পর পর সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লরি, ছোট লরির সামনে এ দিন প্রতিমা নামানোর আগে পর্যন্ত ভিড় করে থাকতে দেখা গিয়েছে বেশ কিছু পুজো কমিটির সদস্যদের। সেখানেই চলেছে ঢাক বাজানো, ছবি তোলা। তবে মাঝেমধ্যেই সেই ভিড় ও গাড়িতে থাকা প্রতিমার উপরে ও ঘাটের চাতালে কলকাতা পুরসভার স্যানিটাইজ়ার ক্যানন দিয়ে ছড়ানো হয়েছে জীবাণুনাশক। বাবুঘাটে থাকা পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘কোভিড পরিস্থিতিতে সমস্ত রকমের বিধি মেনেই কলকাতার ২১টি গঙ্গার ঘাটে বিসর্জন চলছে। পর্যাপ্ত মোটবাহক, ক্রেন, সবই রাখা হয়েছে। গঙ্গা দূষণ রুখতে প্রতিমা জলে পড়তেই ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে।’’ তবে দশমীতে তাঁদের চেতলা অগ্রণীর পুজোর ঘট বিসর্জন হলেও প্রতিমা রয়েছে। যেমন রয়েছে একডালিয়া এভারগ্রিনের প্রতিমাও। পুজোর কর্মকর্তা তথা মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘একাদশীতে বাবুঘাটে বিসর্জন দেওয়া আমাদের পরম্পরা।’’
প্রতিমা রেখে আর দশনার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা বাড়াতে চান না, তাই এ দিন বিকেলেই মাত্র ১০ জন মিলে বাবুঘাটে বিসর্জন দিতে এসেছিলেন বেহালা নতুন দলের পুজোর উদ্যোক্তারা। কমিটির তরফে সন্দীপন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘দর্শনার্থীরা মণ্ডপে ঢুকতে পারছেন না। আজ দশমীর দিনে আর তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া করতে মন চাইছে না। তাই বিসর্জন দিয়ে দিলাম।’’ প্রথমে কয়েক দিন না হলেও, শেষ দু’-তিন দিনে মণ্ডপের বাইরেও বেশ ভালই ভিড় হচ্ছে। অযথা আইনি জটিলতায় না জড়াতে চেয়ে এ দিন রাতেই কুমোরটুলি ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছে উত্তরের জগৎ মুখার্জি পার্ক।
শেষ তিন বছর কার্নিভালের জন্য প্রতিমা রেখে দিত আহিরীটোলা সর্বজনীন। উদ্যোক্তাদের তরফে সোমেন শীল বলেন, ‘‘দূরত্ব-বিধি মানতে এ বছর মণ্ডপে ঢাকিরা ছিলেন না। তবে বিসর্জনে দু’-তিন জন যাবেন। তবে সেটা ঘাটের বাইরে পর্যন্ত।’’
নতুনত্ব: কৃত্রিম জলাধারে প্রতিমার বিসর্জন। সোমবার, ত্রিধারা সম্মিলনীতে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
এ দিন বিসর্জন হয়েছে বাগবাজারের প্রতিমাও। নিজেদের মণ্ডপের সামনেই কৃত্রিম জলাধার বানিয়ে সেখানে প্রতিমা বসিয়ে জলের তোড়ে ধুইয়ে দিয়ে বিসর্জনের পর্ব সেরেছে ত্রিধারা। এ হেন পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বোসপুকুর শীতলা মন্দিরের কর্মকর্তা কাজল সরকার। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের প্রতি বছরই একাদশীর দিন বিসর্জন হয়। এ বারও তাই হবে। তবে আগামী বছরে ত্রিধারার মতো করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছি।’’
আরও পড়ুন: সিঁদুরখেলা, শোভাযাত্রা নেই এ বার, বিসর্জনের আগে প্রতিমা বরণেও পিপিই
এ দিন সন্ধ্যায় বাবুঘাটে এসে পৌঁছয় দেশপ্রিয় পার্কের প্রতিমা। পুজোর কর্মকর্তা সুদীপ্ত কুমার বলেন, ‘‘নির্দেশিকা মেনে মাত্র ১০ জন এসেছি। মহিলারাও নিয়ম মেনে বরণ সেরেছেন।’’ একই রকম ভাবে দূরত্ব-বিধি মেনে ও বরণের থালায় একটি করে স্যানিটাইজ়ারের বোতল নিয়ে মহিলাদের দেবীকে বরণ করতে দেখা গিয়েছে রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘে। ঘট বিসর্জন হলেও হাতিবাগান সর্বজনীনের প্রতিমা সংগ্রহশালায় পাঠানো হবে বলেই জানান কর্মকর্তা তথা ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সাধারণ সম্পাদক শাশ্বত বসু। তবে এ দিন সকাল থেকেই কলকাতার বিভিন্ন ঘাটে শুরু হয়েছে বিসর্জন। অনেক বাড়ির প্রতিমা বিকেলের মধ্যে বিসর্জন হয়ে গিয়েছে।
সকাল ও বেলার দিকে বাগবাজার, কুমোরটুলি, আহিরীটোলা ও বাবুঘাটে বিসর্জনের সময়ে কিছুটা ভিড় থাকলেও দুপুর তিনটের পর থেকে প্রতিটি ঘাটেই কড়াকড়ি শুরু হয়ে যায়। ঘাটের সামনের রাস্তা যেখানে লোকারণ্য হয়ে থাকে, সেখানে এ বারে বেশ ফাঁকা। তা দেখে বাবুঘাটের উল্টো দিকের এক চায়ের দোকানি বললেন, ‘‘আসছে বছর সব ঠিক করে দিয়ো মা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy