অবসরে: স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে অভিজিৎবাবু। নিজস্ব চিত্র
হাতের চ্যানেল আর নলে ঘেরা অবস্থায় শুয়ে তিনি। কিছু বলতে চেয়েও একটা কথা বেরোলো না। ‘বাক্রুদ্ধ’ শব্দটা আগে ব্যবহার করলেও প্রয়োগের সেই শুরু বছর ষাটের চিকিৎসকের। ইশারায় ডাকতেই নার্স মৃদু হেসে শ্লেটটা এগিয়ে দিলেন। ‘এ বার থেকে যা বলতে চান, লিখে বলবেন।’ এ ভাবে হয় নাকি! প্রতিটি কথা, রাগ-দুঃখ, ভালবাসা, অভিমান জানাতে তাকিয়ে থাকতে হবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আর তর্জনীর উপরে! যাকে তিনি হাতের চেটোর থেকেও বেশি চেনেন, সেই হৃৎপিণ্ডটার উপর থেকেও তত ক্ষণে যেন সব নিয়ন্ত্রণ সরে গিয়েছে। চরম হতাশা নিয়েই শুরু হয়েছিল লড়াই। “স্বরযন্ত্র চলে যাওয়া মানে কণ্ঠ চলে গেল। সেই মুহূর্তে মনে হয়, বেঁচে থেকে লাভ কি আর!” এক যুগ আগের সে দিনের ভাবনা মনে করছিলেন বছর তিয়াত্তরের চিকিৎসক।
অবসরের ছ’মাস বাকি। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়োভাস্কুলার সায়েন্স, এসএসকেএমের ডিরেক্টর করে পাঠানো হল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সাল ২০০৭। পূর্ণোদ্যমে কাজ করে চলা বিভাগীয় প্রধান ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) এক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে আটকে গেলেন। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, গলায় টিউমার। বায়োপ্সিতে ধরা পড়ল ল্যারিঞ্জিয়াল ক্যানসার, স্টেজ ওয়ান। বন্ধুর দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমেরিকা নিবাসী ক্যানসার চিকিৎসক প্রবীর চৌধুরী। কিছু দিন পরে ধরা পড়ল, ফুসফুসের ক্যানসারেও আক্রান্ত অভিজিৎবাবু। আমেরিকায় অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হল একটি ফুসফুসের লোব। গলায় রেডিয়েশন দেওয়া হল। দেশে ফিরেই ফের রোগী দেখা শুরু। চেম্বারে যাওয়ার পথে এক দিন তাঁর গাড়ির পিছনে ধাক্কা মারে আরও একটি গাড়ি। ধাক্কার অভিঘাত তখন না বুঝলেও অভিজিৎবাবু তা টের পেলেন মাঝরাতে। শুরু হল বমি। হাসপাতালে নিয়ে যেতে জানা গেল, তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চিকিৎসক জানালেন, রেডিয়েশন নেওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে। পাশাপাশি, ভারসাম্যের সমস্যা, পায়ে অসহ্য যন্ত্রণাও হত রেডিয়েশনের কারণে।
২০১১ সাল। ফিরে এল ল্যারিঞ্জিয়াল ক্যানসার। চিকিৎসক প্রবীরবাবুর তত্ত্বাবধানে আমেরিকায় সাত ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে ল্যারিংজেক্টমি করে বাদ যায় স্বরযন্ত্র। জ্ঞান ফিরলে অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে চিৎকারের আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন তখন। বিদেশেই শুরু হলো স্পিচ থেরাপি। ইসোফেগাস স্বরে কথা বলার হাতেখড়ি। সজ্ঞানে দেড় মাস ধরে রাইলস্ টিউব নিয়ে চলেছিলেন। অভিজিৎবাবুর কথায়, “ওই পর্বে যে দিন মাখন দিয়ে আলু সেদ্ধ খেলাম, সেটাই ছিল আসল অমৃত। অট্টহাসির অভ্যাসটাই ভুলে গিয়েছি। কাশির আওয়াজ এতই বিদঘুটে যে লোকে ঘুরে তাকান।” এখন গলার কাছে একটি গর্ত দিয়েই শ্বাস নেন তিনি। ধুলোবালি-জল থেকে ঢেকে রাখতে হয় সেই গর্ত। সেই সময়ে সব বিতৃষ্ণা ঝরে পড়ছিল চিকিৎসক-স্ত্রী ভদ্রকান্তা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিদেশে থাকা দুই ছেলের উপরে। স্ত্রীর উপরে প্রতিনিয়ত চিৎকার, দুই ছেলের সঙ্গে অভিমানে কথা বন্ধ করে দেওয়া সবটাই ছিল তাঁর চরম হতাশা থেকে। তাঁর থেকে কলেজে দু’বছরের ছোট সহকর্মী-বন্ধু হৃদ্রোগ চিকিৎসক পার্থসারথি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে পড়ে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘরবন্দি করে নিয়েছিলেন অভিজিৎবাবু। তাঁর কথায়, “আমরা হাল ছাড়িনি। ছ’মাসের মধ্যে ওঁর পরিবার-বন্ধুরা চেষ্টা করে ওঁকে ফিরিয়ে আনি স্বাভাবিক জীবনে। ওঁর স্ত্রীর অবদান মনে রাখার মতো।”
মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, এক জন মানুষ যিনি কথা বলার ক্ষমতা চিরকালের জন্য হারালেন, তাঁর এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে কাছের মানুষ অর্থাৎ স্বামী বা স্ত্রী, বাবা বা মা কিংবা সন্তানকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে রোগীর হতাশা দূর করাতে হবে। তাঁকে স্বনির্ভর হতে দিতে হবে। সবটাই আগের মতো থাকবে। বদলাবে শুধু কথা বলার ধরণ।
তাঁর চিকিৎসায় আস্থা রেখে অভিজিৎবাবুকে কাজে ফেরাতে পাশে ছিলেন রোগীরাও। কুড়ি বছর ধরে তাঁর রোগী আলপনা ঘোষ। অভিজিৎবাবু যখন ডাক্তারি ছাড়ার কথা বলেছিলেন, আলপনাদেবীর ছেলে সৌরভ তাঁকে প্রয়োজনে বাড়ি গিয়ে দেখানোর প্রস্তাব দেন। এমন একাধিক রোগীর চাপেই শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তরে গিয়ে এখনও রোগী দেখছেন। ভরসা বলতে গলার কাছে ধরা ইলেক্ট্রো ল্যারিংস যন্ত্রটি। চিকিৎসক হিসেবে অভিজিৎবাবুর অবদান স্মরণ করে কার্ডিয়োলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, পশ্চিমবঙ্গ শাখা এ বছর বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। আর জি করে অভিজিৎবাবুর থেকে এক ক্লাস নীচে পড়তেন দেবনন্দন ঠাকুর। দেবনন্দনবাবুর স্মৃতিচারণে, ‘‘বরাবর অন্যের কথা ভাবা এই মানুষ এখন রোগীদের জন্য ভাবেন আরও বেশি। বছর দেড়েক আগে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরেও আজও বেঁচে শুধু ওঁর জন্য।”
তাঁর মতো এমন উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে সম্প্রতি তৈরি হয়েছে নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত একটি বাংলা ছবি।
শিবপ্রসাদ বলছিলেন, “বেসরকারি চ্যানেলে কাজের সূত্রে বিষয়টা প্রথম জানতে পারি আঠেরো বছর আগে। সেখানেই পরিচয় হয় স্বরযন্ত্র হারিয়েও সবার বন্ধু হয়ে ওঠা এক জনের সঙ্গে। বলা যায়, সিনেমাটির বীজ বপন তখনই। গ্রহণযোগ্য করে সবার কাছে ইতিবাচক এই বার্তা পৌঁছে দিতে একটু সময় লাগল।”
দেবনন্দনবাবুরা মনে করেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা কথায় নয়, কাজ দিয়ে দৃষ্টান্ত গড়েন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy