Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
Interpreter

interpreter: মনের কথা বোঝার খরচ দেবে কে, তাই অপেক্ষায় বিচার

দু’-তিন হাজার টাকা দেওয়ার বদলে পুলিশ জানিয়ে দেয়, ইন্টারপ্রিটার বা স্পেশ্যাল এডুকেটর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ছবি: সংগৃহীত।

ছবি: সংগৃহীত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৪২
Share: Save:

‘‘আপনি বললে হবে! ছেলে তো কিছুই বোঝাতে পারছেন না!’’— অভিযোগ জানাতে বার বার থানায় ঘুরতে থাকা বৃদ্ধাকে চেয়ারে বসিয়ে ধমকের সুরে কথাগুলো বলেছিলেন এক পুলিশকর্মী। যা শুনে বৃদ্ধার আকুতি ছিল, ‘‘কী করব? ও তো কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। ছেলে আমার ছোট থেকেই অন্য রকম। আর তাই রাস্তায় বেরোলে পাড়ার ছেলেরা ওকে ধরে মারে। লাথি মেরে ফেলে দেয়! এ বার মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে...।’’ বৃদ্ধাকে থামিয়ে পুলিশকর্মীর উত্তর ছিল, ‘‘পুলিশের আরও কাজ আছে। যাঁরা নিজেদের অভিযোগ স্পষ্ট করে বোঝাতে পারেন, তাঁরাই তারিখের পর তারিখ ঘুরছেন। তা ছাড়া, বুঝব কী ভাবে যে, আপনার ছেলে কল্পনা করে ওই কথাগুলো বলছেন না!’’

কয়েক বছর আগে মানিকতলা থানায় এমন দৃশ্য চলেছিল কয়েক মাস। সেই খবর সামনে আসতে পুলিশ কয়েক বার শুধু এলাকায় ঘুরে আসে। অভিযোগ, তদন্ত বলতে ওই পর্যন্তই! কয়েক দিন বাদে ওই মা-ছেলের থানায় আসাই বন্ধ হয়ে যায়। পরে খোঁজ করে জানা যায়, বৃদ্ধা মারা গিয়েছেন। ওই মূক ও বধির ছেলেটি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। কোনও মামলা দায়ের হয়নি।

সেই ঘটনার কথা মনে করিয়ে ওই বৃদ্ধার পাশে দাঁড়ানো এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য বললেন, ‘‘এমন বহু মামলাই দায়ের হয় না। বেশির ভাগই থানা পর্যন্ত পৌঁছয় না। যে ক’টা পৌঁছয়, সেগুলি নিয়ে চলে তারিখের পর তারিখ ঘোরানো!’’ অভিযোগ, কখনও বলা হয়, এমন বিশেষ চাহিদাসম্পন্নের জন্য ‘ইন্টারপ্রিটার’ বা ‘স্পেশ্যাল এডুকেটর’ পাওয়া যাচ্ছে না। কখনও জানানো হয়, মামলা লিখে নেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট দিনে ডাকা হবে। কিন্তু সেই তারিখ আর আসে না!

মঙ্গলবার এক মূক-বধির তরুণীর এমনই ঘটনা সামনে এসেছে। জানা গিয়েছে, ওই তরুণী গত ২ জুলাই থানায় যান অভিযোগ জানাতে। কোনও ইন্টারপ্রিটারের সাহায্য তিনি পাননি। নিগ্রহের অভিযোগ লিখে নেয় পুলিশ। প্রায় সাড়ে চার মাসেরও বেশি সময় লেগে যায় আদালতে তরুণীর গোপন জবানবন্দির ব্যবস্থা করতে। তরুণী আদালতে দাবি করেন, নিগ্রহ নয়, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তড়িঘড়ি ধর্ষণের ধারায় মামলা রুজু করে চার জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যে গুরুতর অভিযোগ এক জন ইন্টারপ্রিটারের উপস্থিতিতে প্রথমেই পুলিশের জেনে নেওয়ার কথা ছিল, তা আদালত ঘুরে জানতে হবে কেন? স্বভাবতই উঠেছে এই প্রশ্ন।

ইন্টারপ্রিটার বা স্পেশ্যাল এডুকেটরদের অনেকেরই দাবি, পুলিশেরই দায়িত্ব তাঁদের জোগাড় করা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমে ইন্টারপ্রিটার বা স্পেশ্যাল এডুকেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পরে আর তাঁদের ডাকা হয় না। পারিশ্রমিক শুনেই পুলিশ পিছিয়ে যায়। দু’-তিন হাজার টাকা দেওয়ার বদলে পুলিশ জানিয়ে দেয়, ইন্টারপ্রিটার বা স্পেশ্যাল এডুকেটর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে আবার স্পেশ্যাল এডুকেটরদের দিয়ে ইন্টারপ্রিটারের বা ইন্টারপ্রিটারকে দিয়ে স্পেশ্যাল এডুকেটরের কাজ চালানোর চেষ্টা হয়। এতে অভিযোগকারীর সমস্ত অভিযোগ যেমন বোঝা যায় না, তদন্তও ভুল পথে চালিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

ইন্টারপ্রিটার রজনী বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আইন আর অভিযোগকারীর মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করি আমরা। সেই কাজের পারিশ্রমিক চাইলেই পুলিশ পিছিয়ে যায়। মূলত পুলিশের গাফিলতিতেই বহু অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায়।’’ স্পেশ্যাল এডুকেটর স্বাতী বসু বলেন, ‘‘অপরাধের শিকার হলে যে কোনও স্বাভাবিক মানুষই গুটিয়ে যান। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি হয়। এই পরিস্থিতিতে যে সহানুভূতির প্রয়োজন হয়, তা তাঁরাই দিতে পারেন, যাঁরা দিনের পর দিন ওঁদের নিয়ে কাজ করেন। বিশেষ বিষয়কে আলাদা ভাবে না দেখলে কিন্তু যথাযথ বিচার পাওয়ার অধিকার অধরাই থেকে যাবে।’’

পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, তাদের সব খরচই নথিভুক্ত করা থাকে। কিন্তু ইন্টারপ্রিটার বা স্পেশ্যাল এডুকেটরের খরচ নথিভুক্ত করলে কবে তা পাওয়া যাবে, সেই অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। তাই নিজেদের পকেট থেকে তাৎক্ষণিক খরচের সিদ্ধান্তে বেশির ভাগই পিছিয়ে যান।

অন্য বিষয়গুলি:

Interpreter Kolkata Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE