কোনও রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই শহরের পথ-বিভাজিকা রং করতে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
বস্তির খোলা নর্দমার জলের রাস্তা ছুঁইছুঁই অবস্থা। কিলবিল করছে মশার লার্ভা। সেখানেই নেমে গিয়েছে বিদ্যুতের খোলা তার। দিনকয়েক হল, বৃষ্টি বন্ধ হয়ে কড়া রোদ উঠেছে। কিন্তু কাদা প্যাচপেচে গলির রাস্তা শুকোয়নি। দু’পা এগোতেই চোখে পড়ে, রাস্তায় উপচে পড়ছে জঞ্জাল। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না হওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট হাওড়ার জগৎ ব্যানার্জি ঘাট রোডের এই ‘সাফাই গলি’ বস্তির। যাঁরা শহর পরিষ্কারের কাজ করেন, সেই সাফাইকর্মীদের বস্তিরই নরক দশা।
প্রতিদিন ভোরে এই বস্তির মহিলারাই বেরোন শহর সাফ করতে! কেউ সেতু বা উড়ালপুলে ঝাঁট দেন, কেউ সাফাইয়ের পাশাপাশি সেতু বা রাস্তার রেলিং রং করেন। পুজো এলেই এই গলির বাসিন্দাদের কর্মব্যস্ততা বাড়ে। ‘ওভারটাইম’-এ চলে শহর সাজিয়ে তোলার কাজ। বাড়তি কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে দৈনিক ১৮০ টাকা মজুরির চেয়ে কিছু বেশি পান তাঁরা। বাড়তি ৩০-৫০ টাকা মেলে। ওঁদের কাছে পুজো বলতে ওইটুকুই পাওনা।
বস্তির বাসিন্দা প্রভু দেবী নামে এক মহিলা বলেন, ‘‘ঠিকাদার খুশি হয়ে ওইটুকুই দেন। আমাদের বিমা নেই। কিছু হয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ মেলে না। ১৮০ টাকা রোজের কাজে ক্ষতিপূরণ দেবে কে?’’ বস্তির আরও ভিতরে পূর্ণিমা দেবী নামে এক মহিলার ঘরের কাছে গিয়ে দেখা গেল, নর্দমার পাশেই প্লাস্টিক-ত্রিপলে ঘেরা তাঁর ঘর। দেখা হল পূর্ণিমার মেয়ে কিরণের সঙ্গে। মায়ের কথা উঠতেই কাঁদতে শুরু করেন কিরণ। ডেকে আনেন মাসি সুমিত্রাকে।
সুমিত্রা জানান, এক সকালে এ জে সি বসু উড়ালপুলে ঝাঁট দেওয়ার কাজ করছিলেন দুই বোন। দ্রুত গতিতে আসা একটি গাড়ি ধাক্কা মেরে পূর্ণিমাকে খানিকটা হিঁচড়ে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তত ক্ষণে মৃত্যু হয় পূর্ণিমার। সুমিত্রার কথায়, ‘‘চোখের সামনে বোনকে মরতে দেখেছি। এই বস্তি থেকে যে মেয়েরা কাজে যায়, তাদের অনেকেই গাড়ির ধাক্কা খেয়েছে। অনেকের অস্ত্রোপচার করে রড বসাতে হয়েছে।’’
হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের (এইচআরবিসি) অধীনে থাকা এ জে সি বসু উড়ালপুলে ওই দিন পূর্ণিমা, সুমিত্রারা কাজ করছিলেন ঠিকাদার সংস্থার হয়ে। ‘তুহিন-তমাল কনস্ট্রাকশন’ (টিটিএস কনস্ট্রাকশন) নামে ওই সংস্থা এইচআরবিসি-র দরপত্রে সুযোগ পেয়েছিল। এ ভাবেই একাধিক সংস্থার অধীনে শ্রমিকেরা কাজ করছেন। পুজো আসতেই ব্যস্ত রাস্তা বা উড়ালপুলে রাত-দিন কাজ করেন ওঁরা। অথচ, ওঁদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা নেই। কেন?
শ্রমিক-স্বার্থে কাজ করা সংগঠন ‘নাগরিক মঞ্চ’-এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বলেন, ‘‘কোনও সংস্থাই এই শ্রমিকদের জন্য কিছু করে না। এ দেশের ‘লেবার কোড’ এই রাজ্যে কার্যকর হয়নি। ওই কোড অনুযায়ী শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১৭৮ টাকা হতেই হবে। কোড কার্যকর না হওয়ায় রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি ৩৫৫ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু তা নিয়েও নজর নেই প্রশাসনের। এই ফাঁকতালে ন্যূনতম মজুরি ১৭৮ টাকা থেকে দু’টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা করে রাখা হয়েছে।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘প্রশাসন এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এঁদের জন্য কল্যাণমূলক তহবিল রয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু, এমনকি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও সেখান থেকেই তাঁদের সুবিধা পাওয়ার কথা। দুর্ভাগ্যের কথা, ওই তহবিল অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।’’
টিটিএস কনস্ট্রাকশনের মতো সংস্থাগুলির যদিও দাবি, এই শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থাকে। শ্রমিকদের অংশের টাকা সংস্থা থেকেই দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ন্যূনতম বেতনের নিয়ম মানা হবে না কেন? সেই উত্তর মেলে না। পরিস্থিতির জন্য আঙুল উঠছে প্রশাসনিক নজরদারির অভাবের দিকে।
শ্রম দফতরের কর্তাদের মতে, এমনটা হওয়ার কথাই নয়। ঠিকাদার সংস্থা তো দেবেই, অসংগঠিত, পরিবহণ এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে যুক্ত হিসাবে শ্রম দফতরে নাম নথিভুক্ত থাকলেই যে কোনও শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। দফতরের এক অতিরিক্ত কমিশনার বললেন, ‘‘ঠিকাদার সংস্থারই নাম নথিভুক্তির ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু বহু সংস্থা করে না।’’
পুজো আসে-যায়, পাকে-চক্রে বন্দি সাফাইকর্মীর জীবন বদলায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy