পাঁচ দিন বিদ্যুৎ নেই। পর্ণশ্রীর বৃদ্ধ দম্পতির রাতের সম্বল এই লন্ঠনই। সোমবার সন্ধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র
বিনয় কুমার চক্রবর্তী, বয়স ৮০। দীপালি চক্রবর্তী, বয়স ৭৪। বেহালার একটি বহুতল আবাসনের দোতলায় থাকেন। বিনয়বাবু প্রাক্তন আয়কর-কর্তা।অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে কোনও রকমে গ্রিলের দরজা খুললেন দীপালিদেবী। উপর থেকে লণ্ঠন ধরে সেই অন্ধকার কাটানোর চেষ্টা করছেন স্বামী। উপরে যাওয়ার পর ওই লণ্ঠনের আলোতেই স্বামীর ওষুধের পুঁটলিটা খোঁজার চেষ্টা করছিলেন দীপালিদেবী। কারণ, এই সময় নিয়ম করে ওষুধ খেতে হয় বিনয়বাবুকে। শেষমেষ খুঁজে বার করে ওষুধ দিলেন স্বামীর হাতে। লন্ঠনের আবছায়া আলোতেই নিয়ে এলেন জলের গ্লাস।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কোনও ছবি নয়। এই চিত্র পর্ণশ্রী এলাকার। ঠিকানা ১/১ নিউ পর্ণশ্রী, কলকাতা-৬০। খাস কলকাতা শহরে এ ভাবেই ‘অন্ধকার’-এ রাত কাটছে প্রবীণ চক্রবর্তী দম্পতির। আয়কর বিভাগের ইনস্পেক্টর ছিলেন বিনয়বাবু। কাজের সূত্রেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা তাঁর সারা জীবনেও হয়নি। ৮০ বছরের জীবোদ্দশায় দেখেননি এমন প্রলয়। ভাঙা ভাঙা গলায় লণ্ঠনের আলোয় বসে বলতে লাগলেন, ‘‘বিদ্যুৎ নেই তা-ও পাঁচ দিন হয়ে গেল। জল না থাকলে যে কী কষ্ট, এই শেষ বয়সে এসে বুঝলাম। পাম্পে জল তোলা যাচ্ছে না। নিজে কোনওক্রমে হেঁটে চলে বেড়াই। আমার স্ত্রীরও বয়স প্রায় ৭৪ বছর। জলের জন্য হাহাকার করতে হচ্ছে।’’
খাটে বসে দীপালিদেবী তাঁর কথার সূত্র ধরেই বললেন, ‘‘দেখলেনই তো! কী ভাবে সিঁড়ি দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে আপনাকে উপরে নিয়ে এলাম। তা হলে বুঝুন, এই পাঁচটা দিন আমাদের কী ভাবে কাটছে।’’এই আবাসনেরই অন্যান্য ফ্ল্যাটে আত্মীয়-পরিজনও থাকেন চক্রবর্তী দম্পতির। রয়েছেন কয়েক জন প্রবীণ-প্রবীণাও। তাঁরাও এই পাঁচ দিনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেনআমপানের প্রভাব।
পর্ণশ্রী এলাকারই আরও কিছুটা দূরে তিন তলায় থাকেন আরও এক বৃদ্ধ দম্পতি। উপরে উঠতেই চোখে পড়ল, দরজা হাট করে খোলা। এই অন্ধকারে অপরিচিত এক জনকে দেখেই কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন সত্তরোর্ধ্ব মমতা রায়। স্বামী দীপক রায় শয্যাশায়ী। বয়স হয়েছে ৮৬ বছর। এই অন্ধকারে টর্চ খুঁজতে খুঁজতে তিনি পরিচয় জানার চেষ্টা করলেন। এর পর আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন, ‘‘এই পাঁচ দিন না-পারছি মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, না ছেলে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে।’’ওই দম্পতির ছেলে থাকেন শিকাগোতে। মেয়ে রাঁচীতে। ছেলেমেয়ের সঙ্গে গত পাঁচ দিন ধরে কথা হয়নি বৃদ্ধ দম্পতির। স্বগতোক্তির মতো মমতাদেবী বলছিলেন, ‘‘ছেলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে কী ভাবছে কে জানে! হয়তো ভাবছে, আমরা মরেই গেছি!’’
আরও পড়ুন: ৮০ শতাংশ পরিষেবাই স্বাভাবিক হয়েছে, বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
বিদ্যুৎ না আসায় ভুক্তভোগী। বেহালা পর্ণশ্রীর বাসিন্দা। নিজস্ব চিত্র।
এ সমস্যা শুধু পর্ণশ্রীর নয়, বেহালা থেকে টালিগঞ্জ, যাদবপুর থেকে সন্তোষপুর— দক্ষিণ কলকাতার বহু জায়গাই এখন বিদ্যুৎহীন। তার জেরে কার্যত জলে পড়েছেন এই সব এলাকার বাসিন্দারা। বিশেষ করে বহুতল ফ্ল্যাটে সবচেয়ে বেশি সমস্যা জলের। পাম্পে জল তোলা যাচ্ছে না। পাড়ায় গুটিকয়েক টিউবওয়েল। সেখানেও লম্বা লাইন। দেওয়া যাচ্ছে না মোবাইলে চার্জ। আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগও তাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবে যে বিদ্যুৎ আসবে, তা সঠিক ভাবে বলতে পারছেন না সিইএসসি কর্তৃপক্ষ। শহরবাসীদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ। জ্বালা-যন্ত্রণায় পথ অবরোধ করেই প্রতিবাদে নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাস্তায় পড়ে থাকছেন বহু এলাকার মানুষ।
আমপানের পর কেটে গিয়েছে পাঁচ দিন। পাখা ঘোরেনি, জ্বলেনি আলো। বেহালা সরশুনার বাসিন্দা অনিল বিশ্বাস একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। তাঁর অভিজ্ঞতা আরও ভয়ঙ্কর। জল নেই, আলো নেই, পাম্পের মাধ্যমে ট্যাঙ্কে জল তোলার জন্য স্থানীয় এক জনকে ডেকেছিলেন। এক ট্যাঙ্ক জল ভরতে দাম হাঁকিয়েছেন ১ হাজার টাকা! তা-ও ৩০ জনের পরে সেই জল তুলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছেন জনৈক পাম্পের মালিক। প্রায় অর্ধেক বেলা জলকষ্টের পর ১ হাজার টাকা গুনেই ট্যাঙ্কে জল ভরতে হয়েছে। গত চার দিনে ৪ হাজার টাকা তিনি দিয়েছেন। গোটা বেহালা, যাদবপুর, টালিগঞ্জ-সহ এই সিইএসসি এলাকাগুলিতে এ ভাবে অবৈধ মুনাফা লোটার অভিযোগ উঠেছে একাংশের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বেহালা ১৪ নম্বরে মেয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছেন অনিলবাবু। সেখানে অবশ্য রবিবার আলো জ্বালাতে পেরেছে সিইএসসি।
আরও পড়ুন: দেড় মিনিটের ঝড়ে বিপর্যস্ত জলপাইগুড়ি, ভারী বৃষ্টি চলবে উত্তরবঙ্গে
বেহালা বকুলতলাতেও একই চিত্র। ক্লাবের ছেলেরা ঠাকুরপুকুর থেকে ‘হাইজ্যাক’ করে দুই সিইএসসি কর্মীকে তুলে আনেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা মিলে ১০০ টাকা করে চাঁদা তুলে ১০ হাজার টাকা বখশিসও দেন দু’জনকে। বিদ্যুৎ সংযোগ আনতে পেরে যেন বিশ্বকাপ জেতার উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন বকুলতলার বাসিন্দারা।
কিন্তু তার পরই শুরু হয় নতুন ঝামেলা। লাইটপোস্ট থেকে নামতে না নামতেই একদল লোক ঝাঁপিয়ে পড়েন ওই দুই সিইএসসি কর্মীর উপর। কাদের পাড়ায় আগে যাবেন, তা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক গন্ডগোল। টান-হেঁচড়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই দুই কর্মী। ফলে আর কোনও পাড়ায় আলো জ্বালানো হয়নি তাঁদের।
জল-বিদ্যুতের এমন হাহাকারের ছবি দক্ষিণ কলকাতার বহু পাড়ায়, বহু এলাকায়। মহানগরের মানচিত্রে যেন বিচ্ছিন্ন এক একটি দ্বীপ হয়ে সন্ধ্যার পরেই ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। গরমে হাঁসফাঁস রাতটা কোনওক্রমে কাটিয়ে আবার সকাল থেকে শুরু হচ্ছে লড়াই। জল-আলোর প্রাথমিক চাহিদা মেটানোর লড়াই। এ লড়াই যে আরও কত দিন চালিয়ে যেতে হবে, তা জানেন না তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy