প্রতীকী ছবি।
কান্নাকাটি আজকাল একটু বেড়ে গিয়েছে চেম্বারে। একটা সময়ের পরে ছোটদের কান্নায় অভ্যস্ত হয়ে যান শিশুরোগ চিকিৎসকেরা। তবে ওদের যখন আধো বুলি ফোটে, তখন সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হয়ে ওঠে। কখনও স্টেথোস্কোপটা টেনে নিয়ে আমার বুকে রেখে পরীক্ষা করা। কখনও বা টেবিলে বসে পা দোলাতে দোলাতে এটা কী, ওটা কী, এটা দিয়ে তুমি কী করো— জাতীয় প্রশ্নের ফুলঝুরি ছোটানো। সেই সঙ্গে সদ্য শেখা কবিতা, ছড়া, গান শোনানো তো থাকেই। এই উপরির লোভেই অনেক ডাক্তারবাবু শিশুদের চিকিৎসক হতে চান। আমিও সেই দলেরই এক জন। হাজারো রোগ আর বিষণ্ণতার মাঝে কোনও কোনও শিশু খুশির দমকা হাওয়ায় মন ফুরফুরে করে দিয়ে যায়।
ইদানীং এই পরিবেশটা বদলেছে। ওরা ঢুকেই আমাকে দেখে তারস্বরে কাঁদতে থাকে। কেউ বা ঠোঁট ফোলাতে ফোলাতে দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ‘বা-ই, বা-ই’ (আমাদের ভাষায় যার অর্থ বাড়ি) বলে। কেউ বা বাবা-মায়ের ঘাড়ের কাছে মুখ লুকিয়ে নেয়। আসলে মাস্ক, টুপি, ফেস শিল্ড, চশমার আড়ালে ওরা খুঁজে পায় না পরিচিত ডাক্তারবাবুর হাসি আর অভিব্যক্তি। পিপিই থাকলে তো কথাই নেই। এমন এক অদ্ভুত পোশাক পরা মানুষ যখন স্টেথোস্কোপ উঁচিয়ে এগোন, ওরা ভাবে এক এলিয়েন এখনই অন্য কোথাও ধরে নিয়ে যাবে। শুরু তারস্বরে চিৎকার। বুকের শব্দ শোনার দফারফা।
সেই হাসি, পাকা পাকা কথা আর হাসতে হাসতে একফোঁটা লালা পড়ে যাওয়া এ সবের টানেই চিকিৎসাশাস্ত্রের এই শাখার নির্বাচন। অথচ ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের সেই মিষ্টতা মাস্কের আড়ালে চলে গিয়েছে। ডাক্তারিটা এখন প্রেসক্রিপশন ও ভিজিটের বিনিময় প্রথায় পরিণত হয়েছে। বড় ক্লান্ত লাগে।
আরও পড়ুন: বিমানবন্দরের পার্কিং লটই লকডাউনে ওঁদের আশ্রয়
সে দিন দেড় বছরের এক ফুটফুটে শিশু কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। পরের জন এল এক দশাসই চেহারার বালক। বয়স ষোলো। ওজন ৮২ কেজি। গোপন জায়গায় চর্মরোগ দেখাতে এসেছিল। বেশ কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। বললাম, আগে দেখালে এতটা বাড়াবাড়ি হত না। মা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “লকডাউনের জন্যে ওর বাবা কাজে যেতে পারছেন না ডাক্তারবাবু। এ দিকে, সুগারের জন্য ইনসুলিন নিতে হয়, আরও অনেক রোগ আছে। বাড়িতেই চলতে অসুবিধে হয় ওঁর। ছেলেটা এ বার মাধ্যমিক ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। ছেলেটাই যজমানি করে সংসার আর বাবার চিকিৎসার খরচ চালায়।’’ চেম্বারের এসি-র দিকে হঠাৎ চোখ গেল। একরাশ মন খারাপ করা ঠান্ডা হাওয়া তেড়ে আসছে মনে হল। রিফ্লেক্সেই ওটা বন্ধ করে দিলাম। ওর জীবনযুদ্ধের সামনে এই বিলাসিতা বড্ড বেমানান।
আরও পড়ুন: রোগীর সংখ্যা বাড়লেও করোনায় সেরে ওঠার হার সর্বোচ্চ
দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছা করছিল ষোলো বছরের চওড়া কাঁধকে। করোনার সামনে বুক চিতিয়ে থাকা ওই যোদ্ধাকে। মনে হচ্ছিল, সে-ও তো করোনা যোদ্ধা!
সব কিছু বলার পরে ওজন কমানোর জন্য মাকে পরামর্শ দিলাম, ভাত একটু কম দেবেন। মা করুণ স্বরে বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবু, তিনটের সময়ে পুজো করে এসে যখন আমাদের অন্নদাতা বলে মা আর একটু ভাত দেবে? ওকে না বলার ক্ষমতা থাকে না।’’ উত্তরে কিছু বলার মতো শব্দ আমার কাছে ছিল না। বিষণ্ণতা একলাফে আরও অনেকটা বেড়ে গেল।
কলকাতা থেকে ছুটে আসা গ্রামের চেম্বারে, নিজের বেড়ে ওঠা মাটির কাছে, ডাক্তার না পাওয়া বাবা-মায়েদের কাছে অজান্তে কষ্টগুলোই ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক তৈরি করে দেয়। যে সম্পর্কটা ডাক্তারবাবু থেকে কাকুতে পৌঁছে দেয়।
সম্মুখসমরে আমরা প্রথমে বেশ হতাশ হতাম। যখন দারিদ্রের সঙ্গে, স্বজন হারানোর বেদনার সঙ্গে, একাকিত্বের সঙ্গে, বেকারত্বের সঙ্গে অন্য সৈন্যদের যুদ্ধ দেখি, মনে জোর আসে। কষ্ট কমে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy