উপরে বাঁ দিক থেকে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কুণাল সরকার, অভিজিৎ পাণ্ডে, শ্রীকান্ত আচার্য। নীচে বাঁ দিক থেকে লগ্নজিতা চক্রবর্তী, বিজয় রায়, রিচা ঘোষ, দিতিপ্রিয়া রায়
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সাহিত্যিক
এমনিতেও বাড়ি থেকে কম বেরোই। তাই লকডাউন বেশি বদল আনতে পারেনি। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং স্বাধীন ভাবে হাঁটাচলায় বাধা হয়েছে। চার দিকে মৃত্যু, অনাহারের খবর মনকে অস্থির করে তুলছে, তাই সময় পেলেও লেখায় মনঃসংযোগ করতে পারছি না। কিছু আধ্যাত্মিক লেখা লিখছি অবশ্য। নিজেকে সচল রাখতে নিয়মিত রাতে সুনসান যোধপুর পার্কের দিকে মাস্ক পরে হেঁটে আসি। নাতনির সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাচ্ছি। আমার মতে, লকডাউনের নিয়ম অনেকেই মানছেন। তবে এত জনঘনত্বের দেশে সামাজিক দূরত্ব মানা অসম্ভব। সঙ্গে রয়েছে বাড়ি থেকে দূরে আটকে পড়া মানুষগুলির টাকা-খাদ্যের অভাব। শোচনীয় এই অবস্থায় লকডাউন পুরো সফল কী ভাবে হতে পারে?
কুণাল সরকার
কার্ডিয়োথোরাসিক শল্য চিকিৎসক
ডাক্তারি পড়ার সময়ে প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন ক্লাস দেদার ফাঁকি দিয়েছি। পড়ুয়া ছাত্রীদের থেকে নোট নিয়ে পরীক্ষায় বসতাম। সেই সব দুষ্কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করছি লকডাউনে। ওই সব বই এবং এই সময়ের গবেষণামূলক সংবাদ পড়ে সমৃদ্ধ হতে চেষ্টা করছি। এ দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখছি। তাতেও বিস্তর ফাঁকি দিচ্ছিলাম। গত ৫০ দিনে সেই লেখা গুছিয়ে এনেছি। আমার মনে হয়, বিপুল জনসংখ্যা আর দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষ এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে ভাবে নিয়ম মানার চেষ্টা করেছেন, সেটা কিছু কম নয়। তবে শেষ দু’সপ্তাহ দেখে মনে হল, প্রশাসন করোনাকে কাশ্মীর মনে করছে। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে পুলিশকে বেশি ভরসা করা হয়েছে।
অভিজিৎ পাণ্ডে
ডিরেক্টর ইন-চার্জ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ফায়ার অ্যান্ড ইমার্জেন্সি সার্ভিস
জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। তাই বাড়িতে থাকা অসম্ভব। বরং এমন ভয়ানক পরিস্থিতির সঙ্গে সামনে থেকে লড়ছেন আমাদের কর্মীরা। যে কোনও বিপর্যয় মোকাবিলার কাজে আমাদের কমবেশি অভিজ্ঞতা হয়। এটা তেমন হলেও মোকাবিলার সময়সীমা এবং সতর্কতার মাত্রা, সব অভিজ্ঞতার থেকে আলাদা। কোভিড হাসপাতাল, কোয়রান্টিন কেন্দ্র, আইসোলেশন বিল্ডিং, সরকারি দফতর প্রভৃতি জীবাণুমুক্ত করার কাজ চলছিল আগেই। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্য রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকদের জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করা। পাশাপাশি, কোভিড-১৯ নিয়ে মানুষকে সচেতন করার প্রচার হচ্ছে। কী ভাবে লকডাউন মেনে চলতে হবে তা নিয়েও প্রচার করছে দমকল। সামনে থেকে দেখেছি বড় অংশের মানুষ কিন্তু লকডাউন মানছেন। এত জনঘনত্বের শহরে নিয়ম ভাঙা জনতাও থাকবেই।
শ্রীকান্ত আচার্য
গায়ক
৫০ দিন বাড়িতে কী করে কাটালাম, সেটাই মনে করতে পারছি না। উদ্বেগ, আতঙ্ক, ভবিষ্যতের চিন্তা গিলে খেয়েছে সময়টা। বই পড়া এবং গান নিয়ে চর্চা চালিয়ে গিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই একটানা মন বসাতে পারিনি। একটা অস্থিরতা কাজ করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোভিড-১৯ আমাদের পূর্বের জীবনযাপনে ফিরতে দেবে না। বদলে যাবে মানবজাতির এত দিনের অভ্যাসগুলোই! সেটা কি এত দ্রুত রপ্ত হবে? আমাদের হাতে মিসাইল আছে, ট্যাঙ্ক আছে, অথচ অদৃশ্য শত্রুকে জব্দ করতে পারছি না। মৃত্যু মিছিল দেখতে হচ্ছে, অনাহার দেখতে হচ্ছে। যারা ছোট, তাদের স্বপ্নে দেখা আগামী কাল কেমন হবে, ভাবতে খুব ভয় করছে। এ সবে ক্ষতি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের। অসহায়তা থেকে জন্ম নিচ্ছে অবসাদ।
লগ্নজিতা চক্রবর্তী
গায়িকা
লকডাউনের দেড় বছর আগে থেকেই নিজেকে ভিড় থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। আমি কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। সামাজিক গণ্ডিও ছোট করে ফেলেছি। দর্শন, বেদান্ত, উপনিষদ, রবীন্দ্রনাথ, ক্লাসিক্যাল পিয়ানো, অনলাইনে পাশ্চাত্য সঙ্গীত চর্চা করছিলাম। লকডাউনে সে সব আরও বেশি করে চলছে। ঠিক করেছি, যাঁরা কোভিডের জন্য অর্থ সংগ্রহে অনলাইনে অনুষ্ঠান করবেন, সেখানেই শুধু গাইব। নিজের নাম ব্যবহার করে এই অসময়ে যদি কিছু মানুষের পাশে থাকা যায়, সেটাই জীবনের প্রাপ্তি। প্রত্যেকে সতর্ক থেকে আমরা বরং নিজেদের কাজ করে যাই। বেশি দুশ্চিন্তায় অবসাদ আসবে। এই সময়ে ধৈর্য আগের থেকে বহু গুণ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আর রবিঠাকুরের থেকে ধার করে বলতে চাই, ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে’।
বিজয় রায়
হকার, গড়িয়াহাট
বাবা-মা, বৌ, তিন ছেলেকে নিয়ে সংসার। চুড়ি আর সিগারেট-ঠান্ডা পানীয়ের দোকানটা ভাল চলত। প্রতি গরমে বেশি লাভ হয়। কিন্তু সংসারে এত জন মানুষ, তাই টাকা জমাতে পারিনি। তবে জরুরি কিছুর অভাব হত না। সেই আমি এখন তাকিয়ে থাকি অন্যের দিকে। লকডাউনের শুরুতে হকার ইউনিয়নের তরফে আমাদের কিছু সাহায্য করেছিল। এখন স্থানীয় কাউন্সিলরের সাহায্যে অথবা ধারদেনা করে চলছে। জানি না এ ভাবে কত দিন চলবে! রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়েই বাড়ি আমার। পাশের ১৭ নম্বর-সহ আরও বস্তিগুলিতে কিন্তু মানুষ আড্ডা দিচ্ছেন। পুলিশ দেখলে পালাচ্ছেন। তাঁদের দমবন্ধ পরিবেশে বন্দি থাকার কষ্টটা বুঝি। কিন্তু নিজেদের ভালর কথা ভেবেই তো অভ্যাস বদলাতে হবে।
রিচা ঘোষ
ক্রিকেটার
১৪ মার্চ বডোদরায় ম্যাচ ছিল। সেই সব বাতিল হওয়ায় সোজা শিলিগুড়ি চলে আসি। বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি না। তবে ক্রিকেটের অনুশীলন চলছে পুরোদমে। বরং অনেক বেশি সময় পাচ্ছি। অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের এক্সারসাইজ, শ্যাডো প্র্যাকটিস করছি। বাড়ির সবার সঙ্গে অনেক সময় কাটছে। সামনের বছর মাধ্যমিক দেব। সেই পড়াশোনা করারও সুযোগ পেয়েছি। স্কুলের অনলাইন ক্লাস চলছে। খবর প্রায় দেখিই না। আমার কাছে লকডাউন মানে তাই শুধুই নিজের রুটিনে কিছু পরিবর্তন। আশপাশের মানুষজন প্রায় সকলেই মাস্ক পরে ঘুরছেন, এর বেশি বাইরের বদল বুঝতে চাই না এখনই। নিজের কাজই শুধু করে যাচ্ছি।
দিতিপ্রিয়া রায়
অভিনেত্রী
উচ্চ মাধ্যমিকের এডুকেশন পরীক্ষা এখনও বাকি। পরীক্ষা আর কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে খানিকটা ছুটি কাটানোর মতো ছিল লকডাউনের প্রথম পর্ব। নতুন ফ্ল্যাটের দেওয়ালে পু, টম অ্যান্ড জেরি, মিকি মাউসের মতো কার্টুন চরিত্র আঁকছি। পরিবার আর পপকর্নের (পোষ্য) সঙ্গে সময় কাটাতে পারছি। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে আশপাশের মানুষদের আর্থিক দুরবস্থা শুরু হতে দেখে। যে যতটা পারছি পাশে থাকতে চেষ্টা করছি। সবাই ছোট করে হলেও সেই চেষ্টা করুন। আরও একটি বিষয়, পশুদের উপরে কিছু বিকৃত মানুষের অত্যাচার করার ভিডিয়ো, ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। এখন সেটা বেড়ে গিয়েছে। এই অত্যাচার বন্ধ করতে সবাই চেষ্টা করি। ওই চেষ্টাই কঠিন সময় পেরোতে সাহায্য করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy