অপেক্ষায়: শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুরা। নিজস্ব চিত্র
রাজ্যের জন্য বছরে ১৫ লক্ষ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু টেনেটুনে সংগৃহীত হয় ১৩ লক্ষ ইউনিট। গরমকাল, দুর্গাপুজো, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন রক্তদান শিবির কম হওয়ায় প্রতি বছর ওই সময়ে সঙ্কট থাকেই। তবে এ বার করোনা-আতঙ্কে শিবির বন্ধ থাকায় শুরু হয়েছে তীব্র রক্তসঙ্কট। বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির ভাঁড়ারও শূন্য। দাতা নিয়ে গেলে তবেই সেখান থেকে মিলছে রক্ত। সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক চলছে পুলিশের রক্তে। অথচ এই পরিস্থিতিতেও মিষ্টি, চাল, ডাল, আলুর থেকে কম অত্যাবশ্যকীয় বলে বিবেচিত হচ্ছে রক্ত!
‘‘সর্বত্র মিষ্টির দোকান, বাজার খোলা থাকলেও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে যে, শুধু পুলিশই রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতে পারবে! আর কারও শিবিরের আয়োজনের অনুমতি মিলছে না।’’ —বলছিলেন রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ডি আশিস। তিনি জানাচ্ছেন, রাজ্যের পঞ্চাশ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের জন্য লাগে মোট সংগৃহীত রক্তের ৬০ শতাংশ। আক্রান্তদের বাঁচিয়ে রাখতে সেই রক্ত দিতেই হয়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের একটি সংগঠনের পরিচালিত নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের ডে কেয়ার সেন্টারে যে শিশুরা আসছে তারা সকলেই স্থানীয়। অ্যাসোসিয়েশনের তরফে গৌতম গুহ বলেন, ‘‘ওদের জন্য রক্ত জোগাড় করতে ব্লাড ব্যাঙ্কে দাতা নিয়ে যেতে হচ্ছে।” শহরের একটি বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা অনুময় গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, তাঁদের ব্যাঙ্ক শূন্য। দাতা আনলে তবেই রক্ত মিলবে।
এ ছাড়াও রয়েছেন ব্লাড ক্যানসারের রোগীরা। যাঁদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর রক্ত না দিলে বাঁচানো সম্ভব নয়। দুর্ঘটনা কিংবা জরুরি অস্ত্রোপচারেও রাখতে হয় রক্তের জোগান। এই বিপুল রক্ত কে জোগাবে— এই প্রশ্ন ঘুরছে চিকিৎসক, রোগীর পরিবার এবং রক্তদান আন্দোলনে যুক্ত কর্মীদের মধ্যে।
ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন সমাজকর্মী পার্থ সরকার। ঠাকুরপুকুরের এক ক্যানসার হাসপাতাল এবং পার্ক সার্কাসের একটি শিশু-হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত পার্থবাবু কাছ থেকে দেখছেন এই মুহূর্তে ভর্তি শিশুদের জন্য রক্তের অভাব কতটা। হাসপাতালের নিজস্ব রক্তের ভাণ্ডারও তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন তিনি। মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে প্রয়োজন মতো রক্ত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজগুলির নিজস্ব রোগীর চাপ থাকে, তাই সেখান থেকে প্রয়োজনীয় রক্তের জোগান দেওয়া আদৌ কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই।
হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, লকডাউন উঠে গেলে থ্যালাসেমিয়া রোগী এবং অন্য রোগীদের রক্তের চাহিদা বাড়বে। তাতে বিপুল রক্তের সঙ্কট দেখা দেবেই। তার আগাম প্রস্তুতি এখনই নেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, “শুধুমাত্র পুলিশের রক্তের জোগানের উপরে নির্ভর করা কখনওই উচিত নয়। পুলিশ, ব্লাড ব্যাঙ্ক এবং এলাকাবাসীর মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠা আবশ্যিক। যাতে রক্তদাতাদের কয়েক জনকে প্রশাসনের তরফে গাড়িতে কোনও ব্লাড ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়ে রক্তদানের ব্যবস্থা করা যায়।”
পুলিশ ছাড়া অন্য কারও আয়োজিত রক্তদান শিবির বন্ধ রাখার যে নির্দেশিকা দিন কয়েক আগে দেওয়া হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি সপ্তাহে শহরের কয়েকটি রক্তদান শিবির শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়। পার্থবাবু জানাচ্ছেন, দক্ষিণ কলকাতায় তেমনই বাতিল একটি রক্তদান শিবিরের পাঁচ জন দাতা এলাকা থেকে হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্সে চেপে রক্ত দিয়ে আসেন ঠাকুরপুকুরের এক ক্যানসার হাসপাতালে।
রক্তদান শিবির নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তে হতাশ অস্থি চিকিৎসক এবং থ্যালাসেমিয়া আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রামেন্দু হোমচৌধুরী। তিনি জানাচ্ছেন, মিষ্টির দোকান, রেশন, বাজার খোলা থাকলেও বাঁচার জন্য সব থেকে প্রয়োজনীয় যে রক্ত, তার জোগান বন্ধ রয়েছে! তাঁর প্রশ্ন, “স্থানীয় থানা, পুর প্রতিনিধি এবং দায়িত্ববান ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে ২৫-৩০ জনের শিবির আয়োজন করা কি দুঃসাধ্য হত? একা পুলিশের পক্ষে রক্তের জোগান দেওয়া আদৌ বাস্তবসম্মত?”
সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে মতান্তর রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেও। এক স্বাস্থ্যকর্তার মতে, করোনা নিয়ে এই আতঙ্ক সহজে কাটবে না। অথচ শিবির বন্ধ রাখলে রক্তের অভাব আরও বাড়বে। এ ভাবে জোগান অব্যাহত রাখা অসম্ভব। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত কী ভাবে পাল্লা দেবে বিপুল চাহিদার সঙ্গে? তা জানতে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যকে ফোন এবং মেসেজ করা হলেও কোনও উত্তর মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy