লোকারণ্য: করোনা-কালে দূরত্ব-বিধির কথা ভুলে পুজোর কেনাকাটায় মত্ত শহরবাসী। হাতিবাগানের একটি দোকানে। বুধবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
তিরিশ ফুটের বদ্ধ জায়গায় গাদাগাদি ভিড়। উপস্থিত সকলেই প্রবল ঘামছেন। অবস্থা এমনই যে, হাওয়া চলাচলেরও উপায় নেই! সেখানেই এক জন কার্যত আর এক জনের ঘাড়ের উপর দিয়ে এগিয়ে হ্যাঙারে ঝোলানো শার্ট টেনে নামানোর চেষ্টা করছেন। অন্য এক জন আবার তিন-চারটে ট্রাউজ়ার্স ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে মুখের মাস্ক কানে ঝুলিয়ে চেঁচাচ্ছেন, ‘‘বড় মাপের দিন, বড় মাপ। গরমে আর পারছি না।’’ গভীর সম্মতির সুরে পাশের আর এক মাস্কহীন ব্যক্তি বললেন, ‘‘ঠিক করেছেন। আমিও খুলে ফেলেছি। এত গরমে ও সব পরে থাকা যায় নাকি!’’
পুজোর কেনাকাটা পুরোমাত্রায় শুরু হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে আশঙ্কা ছিলই। শহরের বিভিন্ন বাজারে গত কয়েক দিনের ভিড়ের চিত্র দেখে প্রশ্ন উঠছিল, কেনাকাটাতেই এমন অবস্থা হলে পুজোর চার দিন কী হবে? যদিও চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে শহরের বিপণিগুলির আবদ্ধ জায়গার মধ্যে বাড়তে থাকা মাথার সংখ্যা সেই সব প্রশ্নকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এমনই এক বিপণির ভিড়ের ছবি ইতিমধ্যেই ঘুরতে শুরু করেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, আবদ্ধ জায়গায় বাতাসের চলাচল বাইরের মতো হয় না। তাই সেখানকার বাতাসে অনেক ক্ষণ ধরে ড্রপলেট ঘুরে বেড়াতে পারে। সুতরাং, আবদ্ধ জায়গায় ভিড় করে কেনাকাটার এই অবস্থা চলতে থাকলে তা পুজোর আগেই বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
যদিও বুধবার শহরের বাজারগুলিতে ঘুরে দেখা গেল, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই ক্রেতাদের বড় অংশের। দূরত্ব-বিধি মানার চেষ্টা তো দূর, আবদ্ধ জায়গায় কেনাকাটা করতে ঢুকে অনেকেই অবলীলায় মাস্ক খুলে ফেলছেন। ক্রমাগত স্যানিটাইজ়ার ব্যবহারের উদ্যোগও চোখে পড়ল না। উল্টে গড়িয়াহাটের একটি শাড়ির বিপণিতে প্রবল ভিড়ের মধ্যেই মাস্কহীন এক মহিলা বললেন, ‘‘কুড়ি বছর তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেছি। মাস্ক না পরলে কী হতে পারে, সেই তথ্য আমাকে দিতে হবে না। স্বাধীন দেশ, যখন ইচ্ছে পরব।’’
আরও পড়ুন: মেট্রো চালু হল, সংক্রমণ ফের বাড়ল কলকাতায়, কারণ কি সেটাই?
আর এক বিপণি থেকে ঘামতে ঘামতে বেরোনোর মুখে মাস্ক খুলে ফেলা শোভাবাজারের বাসিন্দা সুকোমল ঘোষ বললেন, ‘‘এত গরমে পারা যায়? একটুও বাড়তি জায়গা রাখেনি। দোকানের মালিকেরাই দায়ী।’’
নিউ মার্কেটের সামনে। বুধবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
হাতিবাগান মোড়ের এক বিপণিতে নাতির জন্য পোশাক কিনতে আসা বছর ষাটেকের প্রৌঢ়া গিরিবালা নাগ আবার বললেন, ‘‘বাড়িতে বসে থাকলে নিজেকে এমনিতেই রোগী বলে মনে হয়। ডাক্তারেরাই তো বলেন, কেনাকাটা করলে মন ভাল থাকে!’’ কিন্তু এই বয়সে এত ভিড়ে…? প্রশ্ন থামিয়ে দিয়ে প্রৌঢ়ার উত্তর, ‘‘এত লোকের যখন হুঁশ নেই, আমি ভেবে কী করব?’’
চিকিৎসকেরা তো বটেই, শহরের সচেতন নাগরিকদের বড় অংশ অবশ্য চাইছেন, পুজোর কেনাকাটার ভিড়ের কথা মাথায় রেখে সরকারের তরফেই বিপণিগুলির জন্য আদর্শ বিধি তৈরি করে দেওয়া হোক। তাঁদের প্রশ্ন, পুলিশই বা কেন বিষয়টি দেখছে না? লালবাজার সদরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিক বললেন, ‘‘কোনও বিপণির মধ্যে ঢুকে ভিড় সামলানো পুলিশের পক্ষে অসম্ভব। তা ছাড়া, এই ধরনের কিছু করতে গেলে উল্টে সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে।’’ রোগের থেকেও কি ‘সমালোচনার ভয়’ বেশি? পুলিশের আর উত্তর নেই।
আরও পড়ুন:বিধিতে কিছু ছাড় চাইছেন সিনেমা হল মালিকেরা
সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বিপণির ভিড়ের ছবি ঘুরছে, তারা অবশ্য জানাল, কয়েক মিনিট পরপরই প্রতিটি সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে। হাতিবাগান মোড়ের একটি বিপণির কর্তারা আবার বললেন, ‘‘ক্রেতারা কোনও জুতো দেখে রেখে দিলেই তা জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। ব্যাগগুলিও কেনার আগে পর্যন্ত প্লাস্টিক থেকে বার না করার জন্য বলা হচ্ছে ক্রেতাদের।’’
ধর্মতলায় এক বহুজাতিক সংস্থার বিপণির দায়িত্বপ্রাপ্ত নীলম গুপ্ত আবার বললেন, ‘‘এ বার অনলাইনেই বেশি কেনাকাটা করতে বলছি আমরা। কিন্তু মানুষ না বুঝলে আমরাই বা কী করব?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy