মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে চিকিৎসার অপেক্ষায় এক রোগী ও তাঁর পরিজন। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
চারটি সরকারি হাসপাতাল ভর্তি না নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। পেট ফাঁপার (অ্যাবডোমিনাল ডিস্টেনশন) সমস্যা ভোগা বোনকে নিয়ে কখনও অটোয়, কখনও বা ভ্যানে শহরের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছেন দিদি। নিরুপায় হয়ে থেকেছেন বেনিয়াপুকুরের ৩০ টাকা ভাড়ার ঘরেও! সেই টাকাও শেষ। এখন তাই চিকিৎসার আশায় তাঁরা ঠাঁই নিয়েছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে।
প্রথমে শুধুমাত্র করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হলেও গত সপ্তাহে ঘোষণা করা হয়েছে যে, নন-কোভিড চিকিৎসাও হবে মেডিক্যালে। তবু এই অবস্থা কেন? মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকা, মালদহের কালিয়াচকের বাসিন্দা শ্যামাদেবীকে দেখিয়ে তাঁর দিদি বললেন, “বোনের পেটে জল জমেছে। নড়তে পারছে না। কোথাও ভর্তিও নিচ্ছে না। এই হাসপাতালও বলছে, করোনা না হলে ভর্তি নেবে না। যাব কোথায়?”
করোনা পরিস্থিতিতে অন্য রোগে আক্রান্তেরা বহু ক্ষেত্রেই চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। শুধু করোনার জন্য কোনও হাসপাতালকে নির্দিষ্ট করা হলে দুর্ভোগ বাড়বে বলেই মত চিকিৎসকদের বড় অংশের।
কলকাতা মেডিক্যালে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা হবে বলে ঘোষণা করা হলেও বাস্তব চিত্রটা যে ভিন্ন, তা দেখা গেল সেখানে গিয়ে। অভিযোগ, শ্যামাদেবীর মতো শয়ে শয়ে রোগী প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন ওই হাসপাতালে। আরও অভিযোগ, বহির্বিভাগ খোলা হলেও করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজ়িটিভ না-এলে কাউকেই ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি দ্রুত অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন থাকা রোগীদেরও বলা হচ্ছে, “অন্য হাসপাতালে যান।” অন্য সরকারি হাসপাতালে গেলে দেখা যাচ্ছে, সেখানেও রোগীর লম্বা লাইন।
পেটের যন্ত্রণা নিয়ে মার্চের প্রথম দিকে শ্যামাদেবী মালদহ মেডিক্যাল কলেজে গেলে তাঁকে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করা হয়। এ শহরে এসে সেখানে ভর্তি হলেও লকডাউনের ক’দিন আগেই হঠাৎ তাঁকে ছুটি দিয়ে দেয় হাসপাতাল। পেটে অস্বস্তি বাড়লেও লকডাউনে কলকাতায় আসতে পারেননি তিনি। আনলক-পর্ব শুরু হতেই ফের দিদির সঙ্গে ন্যাশনাল মেডিক্যালে যান শ্যামাদেবী। দিদির কথায়, “কয়েক দিন ঘুরলাম। তার পরে হাসপাতাল বলে দিল, ২০ দিন পরে যেতে। এ দিকে, বোনের অসহ্য যন্ত্রণা। তাই কলকাতা মেডিক্যালে এলাম।” তাঁর দাবি, “দু’দিন ধরে ঘোরার পরে ৬ জুলাই হাসপাতাল বলে দেয়, এখানে হবে না, এটা করোনা হাসপাতাল। তখন এন আর এসে যাই। সেখানে প্রথমে ভর্তি নেওয়া হয়। কিন্তু পেটের জল বার করতে গিয়ে রক্তও বেরোচ্ছে দেখে বলা হয়, এখানে হবে না। নিয়ে যান। তাই মেডিক্যালেই ফিরে এলাম।”
রোগীর পরিজনেদের অভিযোগ, হাসপাতালের কোথাও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় তাঁদের বুঝিয়ে বলার লোক নেই। কার্যত উঠে গিয়েছে রোগী সহায়তা কেন্দ্রগুলি। এক হাসপাতালকর্মী বললেন, “ঘোষণা যা-ই হোক, এটা এখন করোনা হাসপাতালই। রোগী সহায়তা কেন্দ্রে বসে লাভ কী? অন্য রোগের চিকিৎসা যে হচ্ছে না, একটু ঘুরলেই তা বুঝবেন।”
সেখানেই দিশাহারা হয়ে ছুটে বেড়াতে দেখা গেল ক্যানসার আক্রান্ত এক ব্যক্তির ছেলেকে। উজ্জ্বল বিশ্বাস নামে ওই যুবক জানালেন, তাঁর বাবা রক্তের ক্যানসার নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। লকডাউনের আগে তাঁকে ছুটি দিয়ে বলা হয়, ‘‘এটা করোনা হাসপাতাল হবে। ভর্তি থাকার প্রয়োজন নেই। প্রতি মাসে কেমো নিয়ে গেলেই হবে।’’ কিন্তু লকডাউনের প্রথম দু’মাস শান্তিপুর থেকে কেমোর জন্য আসতেই পারেননি তাঁরা। উজ্জ্বল বললেন, “কেমো বন্ধ থাকা খারাপ। কিন্তু কী করব? টাকার সমস্যা।” কোনও মতে টাকার ব্যবস্থা করে মে মাসে বাবাকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল জানায়, করোনা রোগী ছাড়া ভর্তি হবে না। উজ্জ্বলের কথায়, “অন্য হাসপাতালে গেলে এই চিকিৎসককে পাব না। তিনিই প্রথম থেকে দেখছেন। শেষে ওই চিকিৎসকই ছোট বেসরকারি হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করান। ওষুধের টাকা নেননি, কিন্তু দিনে হাজার টাকা শয্যার ভাড়া দিতে হয়েছে।”
এই হয়রানি কেন?
সুপার ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বললেন, “কাউকে যাতে বিনা চিকিৎসায় ফিরে যেতে না হয়, তার জন্যই বহির্বিভাগ খোলা। সেখান থেকে ভর্তি হতে গেলেও করোনা রিপোর্ট পজ়িটিভ থাকা দরকার। করোনা আর নন-করোনা রোগী তো একসঙ্গে রাখা যায় না।” তা হলে মেডিক্যালে অন্য রোগের চিকিৎসা মানে স্রেফ বহির্বিভাগে দেখে ছেড়ে দেওয়া? ইন্দ্রনীলবাবু উত্তর দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy