সচেতনতায়: অযথা আতঙ্কিত না-হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এক স্বেচ্ছাসেবী নার্স। শনিবার, বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল চত্বরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
করোনা-পরীক্ষার জন্য গেলে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে অপেক্ষা করতে হচ্ছে গড়ে তিন ঘণ্টা। অথচ চিকিৎসকেরা বলছেন, যাঁরা লাইন দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেরই পরীক্ষা করাতে আসার প্রয়োজন নেই। স্রেফ আতঙ্কিত হয়েই অনেকে আসছেন। জনস্বাস্থ্য চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘এ ভাবে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হলে করোনার মতো ভাইরাসের মোকাবিলায় পিছিয়ে পড়তে হবে!’’
এই পর্যবেক্ষণের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আইডি হাসপাতালে কর্তব্যরত মেডিক্যাল অফিসারেরা। তাঁরা জানান, শনিবার প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করে জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসারের কাছে যান দমদমের বাসিন্দা এক চিকিৎসক ও তাঁর ছেলে। ছেলে সম্প্রতি দুবাই থেকে ফিরেছেন। স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশিকা হল, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তির শরীরে উপসর্গ না থাকলে ঘরে কোয়রান্টিনে থাকতে হবে। সেই সময়ে উপসর্গ দেখা গেলে নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে।
বাবার দাবি, নির্দেশিকা মেনেই তিনতলার ফাঁকা ঘরে ছেলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে পাড়ার লোকেরা নিদান দেন, বেলেঘাটা আইডি থেকে ‘কোভিড ১৯ মুক্ত’ শংসাপত্র লিখিয়ে আনতে হবে! বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে হাজির হন ওই চিকিৎসক। নোডাল হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, রোগীর সাধারণ সর্দি-কাশি হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনেও রয়েছে সে কথা। তবুও ‘রেফার টু আইডিবিজি’ লিখতে ছাড়ছেন না চিকিৎসকদের অনেকেই। জনশ্রুতিতে বিশ্বাস করে আতঙ্কিত মানুষের ভিড়ও বাড়ছে।
বিভ্রান্তি কাটাতে জরুরি বিভাগের সামনে ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ড লাগানো হয়েছে। ‘কোভিড ১৯ মুক্ত’, এমন কোনও শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন আইডি-র এক চিকিৎসক। সামাজিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ, স্থানীয় ক্লাব, কাউন্সিলরেরা সার্টিফিকেট আনার জন্য চাপ দিয়ে আইডি-তে পাঠাচ্ছেন। রাজ্য সরকার কী নির্দেশিকা জারি করেছে, সে সম্পর্কে তাঁদের ধারণাই নেই। চাপে পড়ে অসহায় মানুষ বলছেন, কিছু না লিখে দিলে পাড়ায় থাকতে দেবে না! বাধ্য হয়ে রাজারহাটে কোয়রান্টিন কেন্দ্রে অনেককে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে বিপদ বাড়বে! তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে কত জনকে কোয়রান্টিন কেন্দ্রে পাঠানো সম্ভব?’’
আইডি-র চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, প্রায় তিন ঘণ্টা সামান্য জ্বর-সর্দি নিয়ে অপেক্ষা করার পরে এক জন ডাক্তারের কাছে পৌঁছে তিনি শুনছেন, কিছুই হয়নি। নির্দেশিকা অনুযায়ী, আইডি-তে আসার প্রয়োজনও ছিল না। চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘এত ক্ষণ অপেক্ষা করার পরে যদি এ কথা শুনতে হয়, তা হলে তো যে কোনও মানুষই উত্তেজিত হবেন। হচ্ছেও তা-ই!’’
করোনা-পরীক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তি যে বাড়ছে, তা নিয়ে একমত স্বাস্থ্য ভবনের কন্ট্রোল রুমে কর্তব্যরত দফতরের আধিকারিকেরাও। তাঁদের অনেকেই জানাচ্ছেন, দু’ধরনের ছবি পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিদেশ থেকে এলেও নিয়ম মেনে নিজেদের ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ রাখছেন না। তথ্য গোপন করে পাড়া-প্রতিবেশীর বিপদ বাড়াচ্ছেন, সে ধরনের অভিযোগও এসেছে। সেই দলকে খুঁজতে গিয়ে নিয়ম মেনে চলা নাগরিকদের হয়রান হতে হচ্ছে। কন্ট্রোল রুমের আধিকারিকদের একাংশ বলেন, ‘‘যা পরিস্থিতি, তাতে কোভিড-১৯ পরীক্ষা কাদের করাতে হবে, সে ব্যাপারে সচেতন করতে প্রচার প্রয়োজন।’’ জনস্বাস্থ্যের চিকিৎসক সমর বিশ্বাস বলেন, ‘‘দু’পক্ষকেই নিয়ম মেনে চলতে হবে। যাঁরা হোম কোয়রান্টিনে না থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁরাও ঠিক করছেন না।’’
দ্রুত পদক্ষেপ না করলে করোনার মোকাবিলায় যে নজরদারি তৈরি হয়েছে, সেটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখার যুগ্ম সম্পাদক দ্বৈপায়ন মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘করোনা-যুদ্ধ জয়ে আতঙ্কিত নয়, সচেতন থাকুন। আতঙ্কিত হলে মানুষের মধ্যে তথ্য গোপন করার প্রবণতা বাড়বে। দলে দলে করোনা-পরীক্ষা করানোর মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই। অজানা রোগ নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশিকা মেনে চলুন। নির্দেশিকা বদল হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখতে হবে।’’
ঘটনাচক্রে এ দিনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় আতঙ্কের আবহ তৈরি না করার আবেদন জানিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, বিদেশ বা বাইরের রাজ্য থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা ১৪ দিন বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। বাকিদের সুস্থ রাখতে নিজেকে আলাদা রাখুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy