জনহীন: সুনসান নিউ টাউনের বিশ্ব বাংলা গেট চত্বর। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
এত দিন কল্পবিজ্ঞান সিনেমায়, সংবাদমাধ্যমে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা জনমানবহীন শহরের ছবি যেন আজ ‘জনতা কার্ফুর’ সৌজন্যে হাতের সামনে! কার্যত ধূ ধূ করছে গোটা কলকাতা। সেই সুযোগে রবিবারের দুপুর রোদে প্রায় মাঝরাস্তাতেই মাস্ক এঁটে বসে পড়া যুবক পাশের জনকে বললেন, ‘‘যেন মাঝরাতেই আকাশে সূর্য উঠেছে বলুন? ঘড়ি না দেখলে বিশ্বাসই হয় না!’’
পাশে বসা ওই ব্যক্তি বললেন, ‘‘রাতে তো তবু রাস্তায় পুলিশ ঘোরে। কিছু গাড়িও দেখা যায়। এখন তো কিছুই নেই! ভাইরাসের ভয়ে যা হয়, ধর্মঘটীদের ডাকেও তা হয় না।’’ বস্তুত, বন্ধের শহরও শেষ কবে এমন জনশূন্য ছিল, মনে করতে পারছেন না কেউ। যদিও সকালে ইতিউতি ক্রিকেট-ফুটবল খেলা আর বিকেলে অভিবাদন জানানোর নামে পথে নেমে থালা-কাঁসর বাজানো, পটকা ফাটানো— তাল খানিকটা কাটল ঠিকই।
তবে দিনভর শহরের গণ-পরিবহণ তো বটেই, প্রায় ঝাঁপ বন্ধ রেখেছিল বাজারগুলিও। খুব জরুরি প্রয়োজনে হাতে গোনা যে ক’জন রাস্তায় বেরিয়েছিলেন, তাঁরাও নাক-মুখ ঢেকে সুরক্ষা ব্যবস্থা সঙ্গে রেখেছিলেন। যা দেখে অনেকেই বলছেন, ‘‘এ ছিল আগামী লকডাউনের ওয়ার্ম আপ ম্যাচ। বাড়িতে বন্দি থেকে শহরবাসী প্রমাণ করলেন, চূড়ান্ত পর্বের জন্য তাঁরা প্রস্তুত।’’ ঘটনাচক্রে, এ দিনই রাজ্য সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আজ সোমবার বিকেল পাঁচটা থেকে শুক্রবার রাত ১২টা পর্যন্ত লকডাউন থাকবে কলকাতা-সহ রাজ্যের সব ক’টি পুর এলাকা। ছাড় পাবে শুধু অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাগুলি।
জনহীন: জনতা কার্ফুর জেরে প্রায় ফাঁকা বিদ্যাসাগর সেতু। রবিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
শনিবার রাতের লাগাতার বৃষ্টির পরে এ দিন ভোরের দিকে ভেজা শহরে ঘুরে দেখা যায়নি কোনও গাড়ির জট। সকাল ১০টা নাগাদ উল্টোডাঙা থেকে শোভাবাজার, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, এক্সাইড মোড়, হাজরা হয়ে দক্ষিণ কলকাতার অলিগলি ঘুরে রুবি পৌঁছতে অন্য দিনের থেকে অর্ধেকেরও কম সময় লেগেছে। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ মানিকতলা বাজারে গিয়ে দেখা গিয়েছে, সব দোকানেরই ঝাঁপ বন্ধ। সেখানে নিজের জন্য রান্না করতে ব্যস্ত এক জন বললেন, ‘‘আমার মাছের ব্যবসা। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় মাছ নিয়ে বসে পড়তে হয়। আজ যে কেউ আসবেন না, কালই বুঝে গিয়েছিলাম। রাতের জন্য একেবারে এখনই রান্না করে রাখছি। বহু দিন বাদে এমন ছুটি পেয়েছি।’’ যদুবাবুর বাজারের এক আনাজ বিক্রেতা এসেছিলেন সোনারপুর থেকে। বেলা পর্যন্তও ক্রেতা নেই দেখে তিনি বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলছেন, দোকান খোলা থাকবে। কেউ ভয় পাবেন না। তাই দোকান খোলা রেখে মানুষের পাশে থাকতে হবে ভেবে চলে এসেছিলাম। কিন্তু এ তো দেখছি উল্টো বিপদ। কিছু বিক্রিও হল না, বাড়িও যেতে পারব না।’’
দুপুর দু’টো নাগাদ মহাত্মা গাঁধী রোডে দেখা গেল, মাথায় বোঁচকা নিয়ে হাঁটছে ছ’জনের একটি দল। সকলেই বিভ্রান্ত। কলেজ স্ট্রিট মোড়ের কাছে তাঁদেরই এক জন পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কিছু হয়েছে দাদা? রাস্তা এত ফাঁকা?’’ বিরক্ত ওই পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘আপনারা কোথা থেকে আসছেন? কিছুই জানেন না?’’ ছ’জনের মধ্যে এক জন বললেন, ‘‘রিকশা চালাই। বিহারে গ্রামের বাড়িতে ফিরব বলে হাওড়ায় গিয়েছিলাম। ঢুকতেই দিল না।’’
রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ গিরিশ পার্ক স্টেশন থেকে বেরোনোর মুখে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত মেট্রোর এক কর্মী। সহকর্মীদের ভাল থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এত দিন সব ছুটি হচ্ছে, অথচ মেট্রোয় কিছু ঘোষণা হচ্ছিল না। অন্য সংস্থায় কাজ করা বন্ধুরা ঠাট্টা করছিলেন। এখন আমাদের একদম মাসের শেষ পর্যন্ত ছুটি। বাড়ি থেকে কাজ নয়, শুধুই ছুটি। একেই বলে, আগে গেলে বাঘে খায়...!’’
আগে যাওয়া তো দূর, ‘জনতা কার্ফু’তে গোটা শহরেরই মূল মন্ত্র এখন—এক পা-ও যাব না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy