এই ভাবেই নিয়ে যাওয়া হয় মৃতদেহ। —ছবি সংগৃহীত।
ফোনে হাউ হাউ করে কাঁদছেন বহরমপুরের এক বাসিন্দা। তাঁর বাবার মৃতদেহ তখন প্লাস্টিকে মুড়িয়ে গাড়িতে তোলা হচ্ছে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য! টানা দু’রাত ছোটাছুটির পরে বাবার মৃতদেহ পাচ্ছেন মেয়ে। তবু তাঁর কান্না থামছে না! উল্টে বলছেন, ‘‘মানুষটা তো আর নেই। কিন্তু এই ভাবে দেহ নিয়ে ফিরতে হবে ভাবিনি। এমন ভাবে ছুড়ে ছুড়ে মৃতদেহ ফেলা হয়েছে যে, বাবার হাতটাই ভেঙে বাদ হয়ে গিয়েছে! হাত আর খুঁজেও পাইনি। অথচ প্রথম যখন দেখেছিলাম, দু’টো হাতই ছিল।’’ গলা বুজে আসে মেয়ের। তিনি জানান, ওই ভাবে দেহ ছুড়ে ফেলার প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেননি। শেষে বললেন, ‘‘মানুষটা নেই বলে কি আর কোনও সম্মানও নেই?’’
এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বালেশ্বরে রেল দুর্ঘটনার পরে নিকটাত্মীয়ের মৃতদেহ খুঁজতে যাওয়া অনেকেরই অভিযোগ একই রকম। রেলের তরফে যদিও জানানো হয়েছে, ঘটনার অভিঘাত এত আকস্মিক এবং ভয়াবহ যে, কূল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। রেলের এসডিজেএম বিনীত গুপ্ত রবিবার বলেন, ‘‘প্রচুর লোক নিয়োগ করা হয়েছে। অনেকে স্বেচ্ছায় সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। এর পরেও কিছু ক্ষেত্রে এ রকম হয়ে থাকতে পারে। দ্রুত খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ করার জন্য বলছি। আসলে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে যে, সামলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।" এমন বড় দুর্ঘটনায় বহু ক্ষেত্রেই এই জাতীয় পরিস্থিতি হয় বলে এ দিন মন্তব্য করেন রেলকর্তারা।
ভুক্তভোগীদের দাবি, ছোট ছোট লরির মধ্যে এক-একটি মৃতদেহ ধরে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। মৃতদেহের হাত, পা ভাঙলেও ঘুরে তাকানো হচ্ছে না। কিছু দেহ আবার ভরা হচ্ছে সাদা, কালো, ধূসর রঙের চেন আঁটা প্লাস্টিকে। পর পর এই রকম পাঁচ-ছ’টি প্লাস্টিকে মোড়া দেহ মাটিতে শুইয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে মাথার দিক আর পায়ের দিকে। এর পরে একসঙ্গে রীতিমতো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেহ রাখার ঘরে! রামপুরহাটের বাসিন্দা শুকদেব মণ্ডল আবার দাবি করলেন, ‘‘ভাইকে খুঁজতে এসেছিলাম। দেখি, লরির উপরে খোলা আকাশের নীচে সার সার দেহ পড়ে রয়েছে। দু’রাত ধরে ওই অবস্থায় পড়ে থাকা দেহ লোহার রড আর লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে নামানো হচ্ছে! সেখানেই ভাইয়ের দেহ পেয়েছি। লাঠি দিয়ে ঠেলে নামানোর প্রতিবাদ করেছিলাম, লাভ হয়নি।’’
এই পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই তুলনা করছেন করোনা অধ্যায়ের। তখন গড়িয়া শ্মশানে দাবিদারহীন দেহ আঁকশিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়তেই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সময়ে রাজ্যে দেহ সৎকার নিয়ে হাহাকার চলছে। কোভিডে মৃতের দেহ পরিবারের হাতে দেওয়া হচ্ছে না। কী ভাবে আর কোথায় তাঁদের সৎকার হচ্ছে, সেই নিয়েও প্রবল ধোঁয়াশা। রাজ্য সরকারের তরফে তখন যদিও জানানো হয়েছিল, গড়িয়া শ্মশানে দাবিদারহীন দেহগুলির সঙ্গে করোনার যোগ নেই। তবু প্রশ্ন উঠেছিল, করোনা রোগীর হোক বা না হোক, যে কোনও দেহেরই কি সম্মান প্রাপ্য নয়? আইনজীবীরাজানাচ্ছেন, ভারতীয় সংবিধানে আছে, জীবনের অধিকার আসলে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার। নাগরিকের মৃত্যুর পরে তাঁর দেহেরও এই সম্মান প্রাপ্য। একাধিক মামলায় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত মৃত ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস অনুসারে উপযুক্ত শেষকৃত্যের রায়ই দিয়েছে। সেই দেহ অজ্ঞাতকুলশীল, দাবিদারহীন হলেও এই নিয়ম মানতে হবে। তবে কি যে কোনও জরুরি পরিস্থিতিতেই দ্রুত ‘কাজ সারতে গিয়ে’ দেহের সম্মানের দিকটা ভুলে যাওয়া হয়?
সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র বললেন, ‘‘মৃতদেহ নিয়ে এমন সব কাজ আসলে দুঃখের আর এক মাত্রা।’’ তিনি জানান, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে সেই দিকটি মনে করিয়ে বিপুল সংখ্যক মৃতদেহ কী ভাবে সাবধানতা মেনে ও যথাযথ সম্মানের সঙ্গে সৎকার করা যায়, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট গাইডলাইন দেয় রেড ক্রস। উপযুক্ত পরিকল্পনা না থাকলে গণকবর দেওয়ার পরিস্থিতি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেহগুলির শনাক্তকরণ না হলে মৃতদের পরিবারকে যে এক দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে, তা-ও জানিয়েছিল রেড ক্রস। তাঁর মতে, ‘‘এই সব নির্দেশ এ ক্ষেত্রেও মেনে চলা উচিত।’’
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব আবার বললেন, ‘‘সাহিত্যে আছে, মৃত্যুর পরে মানুষ বডি হয়ে গেল! এখানে ‘বডি’ হয়ে যাওয়ার জন্য যে সম্মানহানি হয়, সেটাপরিষেবার অভাবের ফল। এখানে সরকারকেই পরিষেবার ব্যবস্থা করে পদক্ষেপ করতে হবে। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হয় না, অন্তত মৃতের পরিবারের মনটা শান্ত হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy