শিয়রে: বাস-সহ নানা ভারী যানবাহন চলার রাস্তার পাশেই ফুটপাতবাসীদের গেরস্থালি। সেখানেই খেলছে দুই শিশু। হেস্টিংস এলাকায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
ডিসেম্বরের এক শীতের দুপুরে গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচের ফুটপাতে বসে রান্না করছিলেন সুনীতা কুণ্ডু, প্রিয়াঙ্কা প্রামাণিক, সুফিয়া মণ্ডলেরা। পাশেই কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে তাঁদের সন্তানেরা। সুনীতা, প্রিয়াঙ্কারা জানালেন, রাতে ফুটপাতের ধার ঘেঁষেই লম্বা বিছানা পাততে হয় তাঁদের। মশারি টাঙিয়ে তার উপরে কাপড় বিছিয়ে ঘুমোন তাঁরা। এ ভাবেই চলছে বছরের পর বছর। নিরাপত্তার অভাবটাই যেন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তবে, ভয় অন্য জায়গায়।
কী সেই ভয়?
সুনীতা বললেন, ‘‘বেশি রাতে রাস্তা দিয়ে খুব জোরে গাড়ি চলে। মোটরবাইকের রেসও হয়। ভয় করে, যদি কোনও গাড়ি বা মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে আমাদের পিষে দেয়! তাই গাড়ির বা হর্নের শব্দে বার বার ঘুম ভেঙে যায়। বাচ্চারা সেই আওয়াজে ভয় পেয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরে। রাতে অনেক চালকই তো মত্ত অবস্থায় থাকেন।’’
সুনীতার পাশ থেকে প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘‘এই উড়ালপুলের নীচে কোনও
সিসি ক্যামেরা নেই। ফুটপাতের দোকানে লাগানো ক্যামেরায়
আমাদের ভাল করে দেখাই যায় না। উড়ালপুলের নীচে আলোও নেই। ভোটের আগে নেতারা এলেন। আমাদের আধার কার্ড দেখলেন। তার পরে বললেন, এখানে আলোর ব্যবস্থা করে দেবেন। রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাতে আস্তে যায়, তা দেখবেন। কিন্তু ভোটের পরে তো তাঁদের আর দেখা নেই। একটু আলো থাকলে মনে বল পাই।’’
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বস্তি) স্বপন সমাদ্দার অবশ্য বলেন, ‘‘আমরা তো ফুটপাতবাসীদের কাছে বার বার আবেদন করেছি যে, আপনারা পুরসভা ও
সরকারের যৌথ উদ্যোগে তৈরি নৈশাবাসে গিয়ে থাকুন। শহর জুড়ে অন্তত ৪০টির মতো নৈশাবাস আছে। আমরা রেল ও বন্দরের কাছেও আবেদন করেছি, তাদের যে সমস্ত ফাঁকা জায়গা আছে, সেগুলির কয়েকটি পেলে সেখানেও নৈশাবাস তৈরি করা যায়। সেই আবেদনে অবশ্য রেল বা বন্দর, কেউই এখনও সাড়া দেয়নি। তবে, আমরা আরও নৈশাবাস তৈরি করব। সেখানে তো নিরাপত্তার কোনও অভাব নেই। নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন ফুটপাতবাসীরা।’’
সরকারি নৈশাবাসের কথা জানেন ফুটপাতে সংসার করা সুনীতা, সুফিয়ারা। তবে, তাঁরা সেখানে যেতে চান না। গড়িয়াহাটের ফুটপাতের আর এক বাসিন্দা বাপ্পা শেখের কথায়, ‘‘নৈশাবাসে গেলেও আমাদের ঘুম আসবে না। কারণ, সেখানে তো দিনের বেলায় থাকতে দেয় না। দিনের বেলায় কাজকর্ম সেরে রাতে নৈশাবাসে ফিরতে হবে। তা হলে দিনের বেলায় মেয়েরা, বাচ্চারা কোথায় থাকবে? ফুটপাতে আমাদের যাবতীয় জিনিসপত্র রয়েছে। বাসনকোসন রয়েছে। নৈশাবাসে গেলে সে সব কোথায় রাখা হবে? শেষে ফুটপাতের এই জায়গাটুকুও হারাতে হবে।’’ বাপ্পার কথার সূত্রেই সুনীতা বললেন, ‘‘নৈশাবাসে তো স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে থাকতে দেয় না। ছেলেদের আর মেয়েদের ঘর আলাদা। ছেলেদের বয়স ১২ পেরিয়ে গেলেই ওদের আলাদা শুতে হয়। যতই অসুবিধা হোক, রাতে পরিবারের সঙ্গেই থাকতে চাই।’’
হেস্টিংসের কাছে ফুটপাতে আবার দেখা গেল, ফুটপাতবাসীদের সুরক্ষায় ফুটপাতের ধার ঘেঁষে গার্ডরেল বসিয়ে রেখেছে পুলিশ। সেই ফুটপাতের বাসিন্দা রুমা দাস বললেন, ‘‘রাতে আমার ঘুম বেশ পাতলাই থাকে। একটু শব্দ হলেই জেগে যাই। পাশে শুয়ে থাকা ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরি। বরং দিনের বেলায় অনেকটা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।’’ সেই
ফুটপাতেই দেখা গেল, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে এক শিক্ষিকা ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। সেই দিকে তাকিয়ে রুমা বললেন, ‘‘পড়াশোনা করলে ওদের বোধবুদ্ধি বাড়বে। পড়াশোনা করে যদি এখান থেকে বেরোতে পারে, তা হলে ভাল হয়।’’
শহরে প্রায় ২৫ বছর ধরে ফুটপাতবাসীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক সমীরণ মল্লিকের দাবি, ‘‘গত ২৫ বছরে শহরের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আগের তুলনায় ফুটপাতে মেয়েদের ও শিশুদের নিরাপত্তা অনেক বেড়েছে। আমরা ফুটপাতের শিশুদের নাটকের মাধ্যমে সুরক্ষার পাঠ দিই।’’
কিন্তু সত্যিই কি নিরাপদে আছে ফুটপাতের শিশুরা? প্রশ্ন থেকেই যায়। শীতকালে সাড়ে ৫টা বাজলেই আঁধার ঘনিয়ে আসে ফুটপাতে। সেখানে এক মা শিশুকন্যাকে লেপ চাপা দিয়ে ঘুম পাড়ান। অঘটনের ভয়ে মায়ের অবশ্য জেগে ঘুমোনোই অভ্যাস। ফুটপাতে শীতের সন্ধ্যার শেষে এ ভাবেই অনিশ্চয়তার দীর্ঘ রাত নেমে আসে মা ও মেয়ের জন্য।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy