মৃত যুবক দেবায়ন ভৌমিক। —ফাইল চিত্র।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত শরীরে খিঁচুনি দিচ্ছে। তাই বাঁধা হাত-পা। মাথা, কান দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। মল ও প্রস্রাবে ভরে গিয়েছে প্যান্ট। পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম দেবায়ন ভৌমিক (২৫) নামে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এক যুবককে এ ভাবেই নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ট্রলিতে ২৪ ঘণ্টা ফেলে রাখার অভিযোগ করছে তাঁর পরিবার। বারাসতের বাসিন্দা ওই যুবক গত রবিবার বাগুইআটির একটি নার্সিংহোমে মারা যান। মৃত যুবকের বাবার অভিযোগ, চিকিৎসা না পেয়ে পড়ে থাকা ছেলেকে অন্যত্র রেফার করার কথা বলা হলেও তা শোনেনি এনআরএস হাসপাতাল।
মুখ্যমন্ত্রী একাধিক বার নির্দেশ দিয়েছেন, কোনও রোগীকে স্থিতিশীল না করে হাসপাতাল থেকে ফেরানো যাবে না। এনআরএস হাসপাতাল কাগজে-কলমে রোগীকে ফেরায়নি বটে, কিন্তু রোগীর কোনও চিকিৎসাও করেনি বলে অভিযোগ দেবায়নের পরিবারের।
বারাসতের বাসিন্দা দেবায়নের পরিজনেদের দাবি, ওই সময়ে তাঁদের ছেলেকে আইটিইউ শয্যায় রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, সেই শয্যা ছিল না। এনআরএসে দেবায়নকে প্রথম ২৪ ঘণ্টা ফেলে রাখা হয় ট্রলিতে। সেখানে ছেলের ওই অবস্থা দেখে দুর্ঘটনার রাতেই এসএসকেএমে দেবায়নের পরিজনেরা যোগাযোগ করেন। তাঁদের জানানো হয়, এনআরএস রেফার করলে তবেই রোগীকে ভর্তি করানো যাবে। কিন্তু এনআরএস কর্তৃপক্ষ তা করেননি। পরে এনআরএসের এমএসএমএস ওয়ার্ডের শয্যায় রাখা হয় দেবায়নকে।
ওই যুবকের পরিবারের অভিযোগ, ওয়ার্ডে এক রকম ফেলে রাখা হয়েছিল তাদের ছেলেকে। মঙ্গলবার ভর্তির পরে বৃহস্পতিবার বাড়ির লোকেরা বাধ্য হন বন্ড সই করে দেবায়নকে বাগুইআটির একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করাতে। সেখানেই গত রবিবার সকালে দেবায়ন মারা যান। যুবকের বাবা শুভঙ্কর ভৌমিকের আক্ষেপ, ‘‘আইটিইউ শয্যা না থাকলে হাসপাতাল তো রেফার লিখে দিতে পারত। তাতে আমরা অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতাম। জরুরি সময়ে চিকিৎসাটা তো হত!’’
এনআরএস হাসপাতালের সুপার ইন্দিরা দে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ওই সময়ে আইটিইউ শয্যা খালি না থাকায় দেবায়নকে তা দেওয়া যায়নি। তবে তাঁর দাবি, ‘‘যুবকের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা হয়েছে। ওঁর পরিস্থিতি সঙ্কটজনক ছিল। তবে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল না। কেউ বললেই রেফার লেখা যায় না। রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠাতে হলেও সেটা আমাদেরই ব্যবস্থা করে দিতে হয়।’’ যদিও দেবায়নের কী চিকিৎসা হয়েছে, তার কোনও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি।
গত মঙ্গলবার নিকো পার্কের কাছে গাড়ির ধাক্কায় আহত হন দেবায়ন। পাঁচ নম্বর সেক্টরে একটি ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ফেরার পথে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। বিধাননগর (দক্ষিণ) থানার পুলিশ জানিয়েছে, ট্র্যাফিক পুলিশই দেবায়নকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে এনআরএসের জরুরি বিভাগে ভর্তি করেছিল।
দেবায়নের বাবা জানান, ছেলের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাঁরা মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ এনআরএসে পৌঁছন। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখেন, ট্রলিতে শুয়ে রক্তাপ্লুত দেবায়ন। তিনি বলেন, ‘‘সারা রাত ছেলেকে ট্রলিতেই ফেলে রাখা হয়েছিল। মাথা, কান দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে তখনও। একটা ব্যান্ডেজ পর্যন্ত করে দেওয়া হয়নি। ডাক্তারেরা বললেন, ওষুধেই রক্ত বন্ধ হবে। কিন্তু হয়নি। খিঁচুনি দিচ্ছিল বলে ছেলের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছিল। মল ও প্রস্রাবে প্যান্ট ভরে গিয়েছিল। পরিষ্কারও করেনি।’’
তিনি জানান, বুধবার দুপুরে অনেক ধরাধরির পরে আয়ারা তিন দিনের টাকা অগ্রিম নিয়ে ছেলেকে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। তাঁরাই ওই দিন কোনও ভাবে নিয়ে গিয়ে সিটি স্ক্যান করান দেবায়নের। সব শুনে সুপার বলেন, ‘‘এ সব ঘটনা ওঁরা আমাকে জানাননি। আমি জানলে হয়তো এত সমস্যা হত না। কী হয়েছে, আমি খোঁজ নেব।’’
দেবায়নকে ছোটবেলা থেকে চেনেন চিত্রশিল্পী শিপ্রা পাল বেরা। তাঁর কথায়, ‘‘দেবায়ন আমার কাছে আঁকা শিখত। হাসপাতালে পৌঁছে ওর ওই অবস্থা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। আইটিইউ-এর বদলে সাধারণ শয্যায় দেবায়ন পড়ে রয়েছে। বার বার বলা সত্ত্বেও রেফার লিখল না।’’ দেবায়নের বাবা বলছেন, ‘‘হয়তো আমার ছেলে বাঁচত না। কিন্তু সময় থাকতে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারলে স্বস্তি পেতাম। ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরে বন্ড দিয়ে নার্সিংহোমে নিয়ে গেলাম ঠিকই। কিন্তু, তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy