Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

একশো বাড়ন্ত, পাঁচশোর পথ চেয়ে উদ্বিগ্ন মহানগর

পাঁচশোর দেখা নেই। নোট-দৌড়ে দম ফুরিয়ে এসেছে একশোরও। ময়দানে হাজির শুধু গোলাপি। আর তাতে খুশি হওয়া তো দূর, আতান্তরেই পড়েছে আমজনতা। ভোগান্তির ১১ দিনের মাথায় দু’হাজারি নোট হাতে পেয়ে তাঁদের অসহায় প্রশ্ন, কী হবে এত বড় নোট দিয়ে?

বন্ধু পুলিশ। জোড়াবাগানের এক ব্যাঙ্কে। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

বন্ধু পুলিশ। জোড়াবাগানের এক ব্যাঙ্কে। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৬
Share: Save:

পাঁচশোর দেখা নেই। নোট-দৌড়ে দম ফুরিয়ে এসেছে একশোরও। ময়দানে হাজির শুধু গোলাপি। আর তাতে খুশি হওয়া তো দূর, আতান্তরেই পড়েছে আমজনতা। ভোগান্তির ১১ দিনের মাথায় দু’হাজারি নোট হাতে পেয়ে তাঁদের অসহায় প্রশ্ন, কী হবে এত বড় নোট দিয়ে? পাশাপাশি, এ দিন কেন্দ্রের তরফে শুধু প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ব্যাঙ্ক-পরিষেবার আলাদা দিন ঘোষণার পরেও কমলো না তাঁদের দুর্ভোগ। কোথাও আলাদা লাইন নেই। কোথাও বা লাইন আছে, কিন্তু পরিষেবা নেই।

শনিবারের বারবেলায় শহরের ব্যাঙ্ক-এটিএমের লাইন থেকে ভেসে এল অন্য এক সংশয়ও। গুটি গুটি পায়ে মধ্যবিত্ত সংসারে এগিয়ে আসছে সেই মোক্ষম সময়, যা কি না পরিচিত ‘মাসের শেষ’ নামে। এ সময়ে সংসারের ভাঁড়ার ফুরোতে বসে, শেষ হয়ে আসে হাতের নগদটুকুও। আর সপ্তাহখানেক পর থেকেই বেতন ঢুকতে শুরু করবে সকলের অ্যাকাউন্টে। তখনও যদি হাতে উঠে আসে এই দু’হাজার, তবে আক্ষরিক অর্থেই খেতে পাওয়া মুশকিল হবে বলে আশঙ্কা অনেকের।

যেমন, উত্তর কলকাতার শ্যামাপদ গড়াই। ঘোষণা শোনার পরপরই ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা করেছিলেন পুরনো পাঁচশো-হাজারের নোট। হাতে যা খুচরো ছিল, তাতে দিন কয়েক চালিয়ে মঙ্গলবার দশ হাজার তুলেছিলেন ঘণ্টা চারেক লাইন দিয়ে। মিলেছিল পাঁচটা দু’হাজারি নোট। এ দিনও ঠিক তা-ই হল। ব্যাঙ্কের কর্মীরা জানিয়ে দিলেন, একশোর নোট বাড়ন্ত। শ্যামাপদবাবুর কৌতুক, ‘‘ছেলেবেলায় বলতাম, কোনও গুণ নাই যার, তারে কয় বেগুন। আজ হাতের গোলাপি কাগজগুলো দেখে সেটাই মনে পড়ে যাচ্ছে।’’ ওষুধের দোকানি থেকে বাড়ির পরিচারক— অত বড় নোট দেখে সকলে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পরে এমনটাই মনে হয়েছে তাঁর।

এর মধ্যেই নিমতলার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে হাতে দু’হাজার টাকার দু’টি নোট নিয়ে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন সত্তরোর্ধ্ব গীতা দাস। তাঁর স্বামী হাসপাতালে ভর্তি। তিনি টাকা পেলে ওষুধ কেনা হবে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে টাকা হাতে পেলেও তাঁর আশঙ্কা, ‘‘এত বড় নোট ভাঙিয়ে ওষুধ কিনতে পারব তো!’’ পাইকপাড়ার এক বৃদ্ধের মুখে তখন জ্যাকপট-জয়ের হাসি। ব্যাঙ্ককর্মীদের অনুরোধ করে পাঁচটা একশো টাকার নোট তুলতে পেরেছেন যে!

অথচ, অনেকেই ভেবেছিলেন, দিন দুয়েকের অসুবিধা কেবল। তার পরেই তো ব্যাঙ্কে বদলে নেওয়া যাবে পুরনো নোট। টাকা তোলাও যাবে নতুন নোটে। মিলবে নতুন পাঁচশোও। কিন্তু ঘোষণার ১১ দিন পরে দেখা গেল, অসুবিধা তো ফুরোয়ইনি, বরং দু’হাজারি দাপটে তা আরও বেড়েছে! প্রথম ক’দিন যাঁরা জোর গলায় বলেছিলেন, দেশের ভালর জন্য একটু ব্যক্তিগত অসুবিধা সহ্য করাই যায়, তাঁরাও এই ১১ দিন ধরে ভোগান্তির প্রহর পেরিয়ে স্বীকার করছেন, অসুবিধাটা আর ‘একটু’ নয় মোটেই।

বয়স্ক মানুষদের লাইন-ভোগান্তি কম করতে শনিবার ঘোষিত হয়েছিল ‘প্রবীণ নাগরিক দিবস’। প্রতিটি ব্যাঙ্কে নির্দেশ ছিল, বয়স্ক মানুষদের জন্য আলাদা লাইন করতে হবে। এ দিন পুরনো নোট বদল করতে পারবেন শুধু তাঁরাই। কিন্তু এ দিন ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে অভিযোগ, বয়স্কদের আলাদা লাইনই সার, আলাদা পরিষেবা কিছুই নেই। নেই প্রতিবন্ধীদের জন্যও। এমনই অভিযোগ মানিকতলার একটি ব্যাঙ্কে কয়েক ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা জামির খানের।

সকাল সাড়ে আটটা থেকে লাইন দিয়েছিলেন ৭২ বছরের এস এন দাস। দুপুর আড়াইটেতেও ঢুকতে পারেননি ব্যাঙ্কে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘টাকা জমা দেওয়ার, তোলার, বদলানোর একটাই লাইন। ফলে শুধু চেক জমা করতে এসেও এত ক্ষণের অপেক্ষা।’’ হাওড়ার বাকসাড়াতেও ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গিয়ে হেনস্থার অভিযোগ আনলেন বিমলকুমার দাস। সকালে প্রবল ভিড় ঠেলে এগোতেই পারেননি তিনি। অভিযোগ, প্রবীণ নাগরিকদের আলাদা লাইনও ছিল না। বাড়ি ফিরে এসে দুপুরে ফের ব্যাঙ্কে গিয়ে অনেক অনুনয়ের পরে পুলিশ এবং ব্যাঙ্ক-কর্মীর সহায়তায় ব্যাঙ্কে ঢোকেন। তবে ‘টোকেন’ আনেননি বলে তাঁকে টাকা দেওয়া হয়নি। বিমলবাবু বললেন, ‘‘আমার বয়স ৭২। বিভিন্ন অসুখে ভুগছি। এই হেনস্থা প্রাপ্য ছিল না।’’

মানিকতলার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে সত্তরোর্ধ্ব সুমিতা ভট্টাচার্যের আক্ষেপ, ‘‘১৯৭০ সাল থেকে এই শাখায় আমার অ্যাকাউন্ট, তবু চার দিন হয়ে গেল টাকা পেলাম না। সকাল থেকে লাইন দিই, দুপুরে ব্যাঙ্কের দোরগোড়ায় পৌঁছে শুনি, টাকা শেষ।’’ পাইকপাড়ায় লাইনে দাঁড়িয়ে শুভ ঘোষের আক্ষেপ, ‘‘দু’দিন অফিস কামাই হল। কোনও এটিএমে দু’হাজার টাকার কম তোলা যাচ্ছে না। সেটাও ব়ড় নোটে। তাই বাধ্য হয়ে ব্যাঙ্কে। একশো না-হলে চালাতে পারছি না,’’ বললেন তিনি।

মহম্মদ জাফরউদ্দিনের এই নিয়ে পঞ্চম দিন। মানিকতলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ই-কর্নারে লাইনে দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে বলা ভুল, বসে। হুইলচেয়ারে। প্রয়োজন ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে দরকারি পাওনা মেটানোর। হাতে বা অ্যাকাউন্টে এই মুহূর্তে টাকা নেই, তাই ক্রেডিট কার্ডই ভরসা। কিন্তু যন্ত্র খারাপ হয়ে পড়ে থাকায় এক সপ্তাহ ধরে হচ্ছে না সেই কাজটুকু।

সংলগ্ন ব্যাঙ্কের কর্তা জানালেন, যে সংস্থা ই-কর্নারের যন্ত্রগুলির দেখাশোনা করে, তাদের খবর দেওয়া হয়েছে। তবে সময় দিতে পারছে না তারাও। ওই কর্তার কথায়, ‘‘যাঁরা কখনও ই-কর্নার ব্যবহার করতেন না, তাঁরাও চেষ্টা করছেন ব্যাঙ্কের দীর্ঘ লাইন এড়িয়ে ই-কর্নারের মাধ্যমে লেনদেন করার। ফলে ভুলভ্রান্তি হয়ে যাচ্ছে, যন্ত্রও বিগড়ে যাচ্ছে বারবার।’’

বস্তুত, যন্ত্র হোক বা ব্যাঙ্ককর্মী, ১১ দিন ধরে নাগাড়ে কাজ করে বেহাল দশা সকলেরই। এক ব্যাঙ্ককর্মী গণেশ পাল বললেন, ‘‘নোট বাতিলের শুরুর দিন থেকে রোজ সকাল আটটায় ব্যাঙ্কে আসছি। হিসেব মিলিয়ে বেরোতে রাত এগারোটা-বারোটা বেজে যাচ্ছে। ছুটিও পাইনি গত সপ্তাহে। কাল, রবিবার ছুটি নিশ্চিত নয় এখনও।’’ আর এক কর্মী নরেশ কুমার আবার বললেন, ‘‘রোজ এত বেশি পরিমাণে নগদ টাকার লেনদেন হচ্ছে, রাতে হিসেব মেলাতে গলদঘর্ম হতে হয়। মাঝে মাঝে তো হিসেবে গণ্ডগোল হলে পকেট থেকেও কিছু দিতে হচ্ছে।’’

উত্তর কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা গেল, পাড়ার কয়েক জন স্থানীয় যুবক হাত লাগিয়েছেন ব্যাঙ্কের কাজে। সেখানে কর্মী কম। তাই ওই যুবকেরাই নিজেদের উদ্যোগে লাইন সামলানো, গ্রাহকদের টোকেন বণ্টন, বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়া— এ সবের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া জায়গায় জায়গায় ব্যাঙ্কের বাইরে পানীয় জল আর গুড়ের বাতাসা নিয়ে ছোট ছোট টেবিল পেতে বসেছেন স্থানীয় তৃণমূলকর্মীরা। রোদ্দুরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর পরিশ্রম কিছুটা লাঘব করতেই এই উদ্যোগ তাঁদের।

অন্য বিষয়গুলি:

500 notes Demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy