জল-যান: বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে পানীয় জলের জার। বাইপাসের কাছে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
প্লাস্টিকের বড় জার ভর্তি পানীয় জল কিনতে মাসে ন্যূনতম ৪৫০-৬০০ টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ, পুরসভার সরবরাহ করা পরিশোধিত জলে করের প্রসঙ্গ এলেই শাসকের বাঁধাধরা বুলি— জনসাধারণের পক্ষে এই কর বহন করা সম্ভব হবে না। এই ভাবনার কারণ আদি ও অকৃত্রিম রাজনীতি।
এক দিকে রাজনীতি, অন্য দিকে জলের মতো মহার্ঘ সম্পদের ক্রমে নিঃশেষ হতে চলা ভান্ডার। যা উস্কে দিচ্ছে সেই পুরনো প্রশ্ন, সামনে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ জেনেও আর কত দিন এ ভাবে জলের অপচয় চলবে? প্রশ্ন উঠেছে, শুধুমাত্র নির্বাচনে জেতার সুবাদেই কি যে কোনও রাজনৈতিক দল জলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হয়? যেখানে সব সিদ্ধান্তই নেওয়া হচ্ছে জনমোহিনী দৃষ্টিকোণ থেকে, সেখানে জলের ব্যবহার সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের নৈতিক ক্ষমতাও শাসকদল কি পেতে পারে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, এখানে শুধুই শাসকদল দায়ী বললে ভুল হবে, বরং সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই মোটামুটি এক জবাব! প্রয়াত তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ হয়তো পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে চিরাচরিত ধারার বাইরে গিয়ে জলকর চাপানোর মতো ‘দুঃসাহসিক’ সিদ্ধান্ত নেন। তবে দলের বিরোধিতায় তাঁকেও পিছু হটতে হয়েছিল। ফলে রাস্তার কল থেকে জল পড়তেই থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু ক্ষেত্রে শহর, শহরতলি, এমনকি গ্রামেরও মানুষ জারের জল কিনে খান। মধ্যমগ্রাম-বারাসত এলাকায় জারের জল বিক্রেতা এক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, ২০ লিটারের একটি জারের দাম ৩০-৩৫ টাকা। গড়পড়তা একটি পরিবার মাসে এ রকম ১৫-২০টি জার নেয়। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁদের বাড়িতে পানীয় জল পরিশোধনের যন্ত্র নেই, তাঁরা বেশি করে জারের জল কেনেন। এমনকি, যাঁদের ওই যন্ত্র রয়েছে, তাঁদের অনেকেও ওই জার কিনছেন।’’ সেখানে জনগণের পকেটের কথা তুলে জলকরে
কেন আপত্তি?
অথচ, বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, রাজ্য বা কলকাতা পুরসভায় ক্ষমতাসীন দলের নীতির বাইরে না গিয়েও কিন্তু অপচয় বন্ধের জন্য জলকর ধার্য সম্ভব। কী ভাবে? তারই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ জানাচ্ছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কেন্দ্রীয় আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রের খবর, দেশের শহরাঞ্চলে মাথাপিছু দৈনিক ১৩৫ লিটার জল যথেষ্ট। গ্রামীণ এলাকায় তার পরিমাণ মাথাপিছু দৈনিক ৫৫ লিটার। সেখানে কলকাতার মানুষ মাথাপিছু দৈনিক ২০২ লিটার জল পান। এক বিশেষজ্ঞের প্রস্তাব, মাথাপিছু ২০০ লিটার ধরে চার জনের পরিবারে দৈনিক মোট ৮০০ লিটার জল বিনামূল্যেই দেওয়া হোক। তবে তার বেশি জল অপচয়ের জন্য মোটা টাকা জরিমানা ধার্য করা হোক। ওই বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘দেখা যাবে, যাঁরা পুরসভার পরিশোধিত জল হেলায় অপচয় করছেন, তাঁদেরই অনেকে বাজার থেকে জার ভর্তি পানীয় জল প্রতি মাসে কিনছেন।’’
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তা হল, ‘জলকর’ শব্দে শাসকদলের আপত্তি রয়েছে। কারণ, কর বললে তা সর্বসাধারণের উপরে ধার্য নির্দিষ্ট টাকা বোঝায়। যে কারণে কলকাতা পুরসভার মেয়র তথা পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলছেন, ‘‘জল তো জীবন। জীবনের উপরে কি কোনও কর হয়?’’ কিন্তু জরিমানা তা নয়, বলছেন অনেকে। কেউ নিয়মভঙ্গ করলে তবেই জরিমানা ধার্য হয়। এ ক্ষেত্রে জল অপচয় করলে তবেই কোনও পরিবার জরিমানার আওতায় আসবে। এক অর্থনীতিবিদের প্রস্তাব, ‘‘জলকরে আপত্তি থাকলে জল-জরিমানা ধার্য হোক। যেমন, অন্য অনেক জরিমানা রয়েছে। তাতে তো শাসকদলকে নীতি-ভ্রষ্ট হতে হবে না।’’
ফলে ‘কর’ না ‘জরিমানা’, এর মধ্যেই আপাতত আটকে শহরের ‘জলভাগ্য’! মনে করছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy