ফুটবল দল গড়ছে সোনাগাছি। — প্রতীকী চিত্র।
অভাবের চেয়ে পরিচয়ের অন্ধকারটাই ওঁদের কাছে বড় বাধা। সেই বাধা ভেঙে বেরিয়ে আসতে লেখাপড়ার সঙ্গে এ বার খেলার মাঠকেও বেছে নিতে চাইছেন সোনাগাছির ছেলেমেয়েরা। এশিয়ার বৃহত্তম যৌনপল্লিতে অনেক প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু তাঁদের খুঁজে পাওয়াই যায় না বলে মনে করেন রতন দলুই। যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি’ তৈরি হয় ১৯৯৫ সালে। এর পরে পরেই ২০০৬ সালে তৈরি হয়েছিল যৌনকর্মীদের সন্তানদের সংগঠন ‘আমরা পদাতিক’। সেই সংগঠনের সভাপতি রতন। তিনিই এ বার উদ্যোগী হয়েছেন সোনাগাছির ফুটবল দল গড়তে। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের দলও চান বানাতে রতন। আপাতত ছেলে, মেয়ে সকলকে নিয়ে মঙ্গলবার থেকে সোনাগাছিতেই শুরু হচ্ছে প্রশিক্ষণ।
কেন এমন উদ্যোগ? রতন বললেন, ‘‘আমাদের পাড়ার ছেলেময়েদের দিশা দেখানোর কেউ নেই। এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে তো খেলাধুলো করা ভাল। এই মাঠ থেকেই দেখবেন এক দিন বড় ক্লাবের ফুটবলার উঠে আসবে।’’ শুধু সোনাগাছিই নয়, কলকাতার যেখানে যত যৌনপল্লি রয়েছে, তাদের সকলকে এক মাঠে এনে প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে। প্রধান কোচ হবেন মিলন সরকার। রতন জানালেন, মিলন নিজেও যৌনকর্মীর সন্তান। রামবাগানে বাড়ি। খুবই ভাল খেলেন। তবে তাঁর নির্দিষ্ট কোনও ক্লাব নেই। যদিও ‘খেপ’ খেলার জন্য নাম রয়েছে গোলরক্ষক মিলনের। এক একটা ম্যাচের জন্য হাজার পাঁচেক টাকা পারিশ্রমিক তাঁর।
মিলন এখন বিদেশে। তবে ফিরবেন খুব তাড়াতাড়ি। মিলন ‘দুর্বার স্পোর্টস অ্যাকাডেমি’-র সঙ্গেও যুক্ত। বারুইপুরের এই সংগঠনটি যৌনকর্মীদের সন্তানদেরই। আইএফএ অনুমোদিত এই অ্যাকাডেমিতে অবশ্য যে কেউ প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। রতন বলেন, ‘‘এখন সোনাগাছিতে যে প্রশিক্ষণ হবে, সেটাকে প্রাথমিক পর্যায়ের বলতে পারেন। এখান থেকে বাছাইদের বারুইপুরের অ্যাকাডেমিতে পাঠানো হবে। তবে প্রশিক্ষণের পরে আমাদের দলেই খেলবে ওরা। আমাদের দলের নামও হবে ‘আমরা পদাতিক’।’’ মিলনকে নিয়েও আক্ষেপ রয়েছে রতনের। তিনি বলেন, ‘‘অনেক প্রতিভা ছিল মিলনের। কিন্তু খেপ খেলে-খেলে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। এখন কথা দিয়েছে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেবে। আমাদের পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গেও ওর সম্পর্ক ভাল। সকলে ওর কথা শোনে।’’
দল গড়ার আগে অবশ্য একটু ভাবনাও রয়েছে রতনের। তাঁর কথায়, ‘‘দল গড়া মানেই তো খরচ। খাওয়াদাওয়া থেকে জার্সির খরচ। এ সবের জন্য আমরা শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য চাইছি।’’ ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের দলও গড়ার দায়িত্ব পেয়েছেন কালীঘাটের এক যৌনকর্মীর সন্তান রবীন বাগ। একটা সময়ে মাঝমাঠের খেলোয়াড় ছিলেন রবীন। তবে পায়ে গুরুতর চোট পেয়ে এখন আর খেলতে পারেন না। অনুশীলন করান ভবানীপুর সুপার মর্নিং ক্লাবে। তিনিই মেয়েদের দল গড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। রবীনও বললেন, ‘‘চাইলেই তো আর হয়ে যাবে না! তবে আমি লেগে রয়েছি। শহরের যেখানে যেখানে যৌনপল্লি রয়েছে, সেখানকার ছোট মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছি। মায়েদের রাজি করাচ্ছি। দল আমি বানাবই।’’ কালীঘাটের বড় গলির অনেক মেয়েই ভাল খেলে বলে দাবি করে রবীন বলেন, ‘‘আমার ইচ্ছা আছে, হরিশ পার্কে মেয়েদের প্রশিক্ষণ করাব। ওখানে আরও একটা ক্লাবের প্রশিক্ষণ চলে। তাদের সঙ্গে কথা বলে সময় ঠিক করে নেব।’’
রতন-রবীনের আক্ষেপ যে, অতীতের মতো এখন আর যৌনকর্মীদের সন্তানদের ফুটবল লিগ হয় না। করোনার সময়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ‘আমরা পদাতিক লিগ’ নিয়ে সেই সময়ে বিভিন্ন যৌনপল্লির সন্তানদের মধ্যে সারা বছর টান টান উত্তেজনা থাকত। সোনাগাছির কাছেই বিডন স্ট্রিটে কোম্পানি বাগানের মাঠে হত সাত জনের দলের ফুটবল প্রতিযোগিতা। কলকাতার কালীঘাট, খিদিরপুর, সোনাগাছি, রামবাগান, শেঠবাগানের মতো যৌনপল্লির দল যেমন থাকত, তেমনই জেলা থেকে শান্তিপুর, কালনার দলও আসত।
তবে অতীতচারণ না করে আপাতত রতন-রবীনরা মঙ্গলবারের দিকে তাকিয়ে। সে দিন থেকে সোনাগাছির ঠিক উল্টো দিকে দর্জিপাড়া পার্কে বল নিয়ে দাপাবেন সোনাগাছির ছেলেমেয়েরা। বাড়ির অন্ধকার আবহ ভুলে আলোয় ভরা আকাশের নীচে গোল দেওয়া আর গোল বাঁচানো শিখবেন যৌনকর্মীর সন্তানেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy