কলকাতা মজেছে ক্যাফের মৌতাতে। ছবি সৌজন্যে: সিয়েনা ক্যাফে
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর নেই?
না, না, আছে! নানা বয়সের মানুষ জড়ো হচ্ছেন শহরের বিভিন্ন ক্যাফেতে, কেউ আড্ডার অছিলায়, কেউ অন্য কোনও কারণে।
১৯৭০-এর দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজে নিয়মিত আসতেন শ্রীময়ী চট্টোপাধ্যায়। এখন দিল্লিনিবাসী, তবে কলকাতায় এলেই দেখা করেন পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। কফি হাউস নয়, এ দিক-ও দিক অন্য কোনও ক্যাফেতে। ‘‘কফি হাউসেও ঢুঁ মারি’’, বললেন শ্রীময়ীদেবী, ‘‘তবে বন্ধুদের সঙ্গে দু’দণ্ড নিরিবিলি কথা বলার জন্য কলকাতার নতুন ক্যাফেগুলিই বেশি ভাল।’’
বছর দশেক আমেরিকায় থাকেন প্রতীম চট্টোপাধ্যায়। দু’বছরে এক বার আসেন দেশে। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী এই অধ্যাপক কিন্তু রিইউনিয়নের জন্য দক্ষিণ কলকাতার নতুন কোনও জায়গাই পছন্দ করেন। বসতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। খরচ বেশি ঠিকই তবে কলেজ স্ট্রিটের কফির স্বাদ খুব ভাল নয়।’’ প্রতীমের ক্যাফে প্রেমের যুক্তি আরও জোরালো।
শ্রীময়ীদেবী বা প্রীতম চট্টোপাধ্যায়ই শুধু নন, বহু কলকাতাবাসীই আজ আড্ডা বলতে ক্যাফে বোঝেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ, নিত্য নতুন গজিয়ে ওঠা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঠেকগুলিতে পা রাখলেই বোঝা যাবে, সব বয়সের মধ্যে এই নয়া আড্ডাখানাগুলি তুমুল জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বক্তৃতা
পুরনো আড্ডার জায়গাগুলিই বরং কিছুটা নিষ্প্রভ। বিকেলে ছাদের খোশগল্পের চেনা ছবিটাও যেন কিছুটা ম্লান। পাড়ার রোয়াক যেন উঠে এসেছে এই নতুন স্পেসে। কিন্তু কেন রাতারাতি এই চাহিদা তৈরি হল কফিশপগুলির? নতুন প্রজন্ম বলছে ফ্রি ওয়াইফাই, যত ক্ষণ খুশি বসতে পারার স্বাধীনতাই তাদের কাছে ক্যাফের টিআরপি বাড়ার একটা বড় কারণ। আবার একঘেয়ে গন্তব্যে না গিয়ে অনেকের মধ্যে স্বাদবদলের ইচ্ছেও মাথাচাড়া দিচ্ছে।
নিজের সঙ্গে সারাদিন, ডেস্টিনেশন কলকাতার কফিখানা। ছবি: শুভেন্দু চাকী।
“শেষ কয়েক বছরে আমূল বদলে গিয়েছে কলকাতার ছবি,’’ বললেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ‘‘প্রতি দু’কিলোমিটারে অন্তত পাঁচ-ছ’টা ক্যাফে দেখা যাবে। কফির যা দাম, আমাদের যৌবনে তা কল্পনা করতেও পারতাম না।’’ উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, কলকাতা আজ ক্যাফেময়। অফিস পাড়াগুলির মোড়ে মোড়ে ক্যাফে কফি ডে, পার্ক স্ট্রিট বা সাউথ সিটি মলের স্টারবাকস, বারিস্তার মতো কফি চেনগুলি এক দিকে, আর অন্য দিকে হিন্দুস্তান পার্ক, গল্ফগ্রিন, গোলপার্ক, শরৎ বসু রোড, শ্যামবাজার, সিঁথির মোড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র ছোট ছোট কফিখানা। কলকাতা যেন আরব্য রজনীর গল্পের শহর!
আরও পড়ুন:১৯৯৮: অমর্ত্য সেনের নোবেল বক্তৃতা
তবে বহুজাতিক কফি চেনগুলি আর ছোট ক্যাফেগুলি স্বভাবে, মেজাজে আলাদা। বহুজাতিক সংস্থাগুলির কফি চেনগুলিতে এক পেয়ালা ফেনায় নকশা তোলা ক্যাপুচিনো ও সামান্য স্ন্যাক্স খেতে জনপ্রতি ন্যূনতম পাঁচশো টাকা খরচ হয়। লাঞ্চ সারতে হাজারখানেক তো বটেই। এই ধরনের ক্যাফের যে কোনও একটিতে পা রাখলেই বোঝা যাবে এই ক্যাফেগুলিতে আড্ডাধারী তরুণ-তরুণীরা রোজ নিয়ম করে যান না। বরং যান কেজো মানুষ। বিজনেস টক, কর্পোরেট মিটিং চলে অহরহ। কাজের মানুষের কাছে এই জায়গাগুলি শুধুই ক্যাফে নয়। শিলাজিৎ বললেন, ‘‘কানেক্টিং পয়েন্ট’’। ‘‘এখন বহু মিটিং ক্যাফেতেই হয়, অফিস স্পেস রাখার ঝক্কি নেই। এখান থেকে কেউ তুলে দেবে না,’’ অকপট ‘ঝিন্টি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস’-এর গায়ক।
স্টারবাকস-এর এক কর্মীও সমর্থন করলেন এই যুক্তি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তির কথায়: “আমাদের স্টোরগুলি সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা সারেন এখানে, এমনও হয় কেউ একটা গোটা ইন্টারভিউ প্রসেস হয়তো এখানে বসেই সেরে ফেললেন। টেবিলে টেবিলে ঘন ঘন যায় ক্যারামেল কফি, এসপ্রেসো। আমরা এগুলিকে মজা করে বলি, ওয়ার্কার্স ড্রিঙ্ক।’’
নামী ব্যাঙ্কের কর্মী অনন্যা মুখোপাধ্যায়। শপিং সেরে সপরিবার স্টারবাকসে বসছেন। কেন স্টারবাকস? জিজ্ঞেস করায় অনন্যার যুক্তি, “পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে রেস্তরাঁ অনেক। তবে আমরা লাঞ্চ সারতে আসিনি, এসেছি একটু জিরিয়ে নিতে। এই এলাকার কফিচেনগুলির মধ্যে স্টারবাকস অপেক্ষাকৃত ভাল। এখানকার ক্রোসা পাফ স্যান্ডুইচ উইথ রোস্টেড চিকেনটা, চিকেন হ্যামটা দারুণ।” স্টারবাকসের কফি নিয়ে কিন্তু অনন্যা উৎসাহী নন। তাঁর কথায়: ‘‘কলকাতার ছোট ছোট কফির দোকানগুলির কফি স্বাদে অনেক বেশি ভাল আর দামেও সস্তা।’’
কফি হাউসের আড্ডার চার্ম আর সিসিডি অথবা স্টারবাকসের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলির বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেই গড়ে উঠেছে ছোট ছোট ক্যাফেগুলি। ছোট ক্যাফের মালিকেরা বুদ্ধি করে বাছাই করেছেন বিপণন কৌশল। কারও পছন্দ বাঙালিয়ানা, কেউ একটা আন্তর্জাতিক মেজাজ তৈরি করেছেন, কেউ আবার স্রেফ খোলামেলা আড্ডার স্পেস তৈরি করতেই বদ্ধপরিকর। কলেবরে খুব বড় নয় এই ক্যাফেগুলি। কোনও সরকারি কফি বোর্ড নয়, দেখা যাচ্ছে এই ছোট ক্যাফেগুলি চালাচ্ছেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীরা। নতুন পেশা কতটা আশ্বস্ত করছে তাঁদের?
বছর চারেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পড়া শেষে কলকাতায় নিজের বাড়ি ফিরেছিলেন সুলগ্না ঘোষ। ইচ্ছে ছিল অল্প দিন কলকাতায় কাটিয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য ফের অন্যত্র পাড়ি দেওয়ার। অবসরে মায়ের মাটির বাসনপত্রের ওয়ার্কশপে সঙ্গ দেওয়া মেয়েটি চার বছর সময় পেরিয়ে এখন ঝাঁ চকচকে কফিখানা— সিয়েনা স্টোর অ্যান্ড ক্যাফের মালিক। কফির ঠেক, বুটিক দুই-ই চলছে। কারা তাঁর ক্রেতা, কেন হঠাৎ এই পেশা বেছে নিলেন সুলগ্না? বছর ত্রিশের সপ্রতিভ উদ্যোগী সুলগ্নার গলায় আত্মবিশ্বাসের সুর। ‘‘আমাদের স্টোরটায় খুব ছোট করে ক্যাফেটা শুরু করেছিলাম। দেখলাম লোক বাড়ছে প্রতি দিন। স্টোরে যাঁরা আসছেন তাঁরা তো বটেই, শুধু ক্যাফেতে সময় কাটাতেই আসছেন অনেকে। আহামরি খাবার খেতে নয়, ব্যক্তিগত সময় কাটানোতেই মানুষের আগ্রহ। অনেকে হয়তো বন্ধুবান্ধব-সহ এলেন, কেউ আবার একাও আসেন। একান্তে বসে কাজ সারেন। এঁদের সবার জন্য ফ্রি ওয়াইফাই মাস্ট। আমরা নানা ধরনের স্যালাড, স্যান্ডুইচ, প্ল্যাটার প্ল্যান করেছি, সেগুলিও লোকে পছন্দ করে। আমার ভাল লাগে এই যাতায়াত, যাঁরা আসেন এখানে নিয়মিত, তাঁরাও আমার পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছেন,’’ বললেন সুলগ্না। ফের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা আপাতত বাতিল। বরং ক্যাফেটাকেই আরও বড় করতে চান তিনি। চোখে চোখ রেখে লড়ছেন বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গেও। সিয়েনা স্টোর অ্যান্ড ক্যাফে হিন্দুস্তান পার্ক পেরিয়ে এখন শাখা খুলেছে পার্ক স্ট্রিটেও।
সিয়েনার অন্দরসাজ। ছবি সৌজন্যে: সিয়েনা ক্যাফে
মেরেকেটে কুড়ি জন বসতে পারে গলফ্ গ্রিনের ট্রাভেলিস্তান ক্যাফেতে। দু’ভাগে ভাগ করা ট্রাভেলিস্তানের আড্ডাঠেকের ভিতরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা অংশ। স্মোকারদের জন্য অন্য ব্যবস্থা রয়েছে খোলা জায়গায়। দেওয়ালে দেশবিদেশের মানচিত্র। এক কোণে রাখা রিসাইকেল করা পুরনো ভাঙা স্কুটার। যাত্রাপথের আনন্দগানই এই ক্যাফের টিআরপি। ক্যাফের কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত নিজের যাত্রার গল্প বললেন, “যাঁরা একটু নিজের মতো করে স্বাবলম্বী হতে চান তাঁরা ক্যাফের দিকে ঝুঁকছেন। সোশ্যাল মিডিয়া আন্তর্জাতিক খাবারদাবারগুলির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় করিয়েছে। সেটাকেই কাল্টিভেট করছ আজকের ক্যাফেগুলি। আমি আর আমার পার্টনার পারমিতাও তাইই করছি আমাদের মতো করে। আমরা ক্যাফেটাকে একটা থিমে বেঁধেছি। আমরা ভ্রমণকে প্রোমোট করি। ছোট ছোট ট্রাভেল আড্ডা বসাই। রথীন্দ্রনাথ দাস বাইকে করে ১৩টি দেশ ঘুরছেন, তিনি যাত্রা শুরু করেছেন আমাদের ক্যাফে থেকে। আমাদের ক্যাফেতে সবচেয়ে পপুলার এক ধরনের সরবৎ— ‘জুজু’। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই আমরা বেশ কিছু স্পেশাল ডিশ তৈরি করি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চেনা বন্ধুদের আগেভাগে জানিয়েও দিই সেই খবর।’’
দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত চা পরিবারের ছেলে শৈলেশ সিংহ সমতলে নেমে এসেছেন ব্যবসার প্রসারে। গোলপার্কের মুখে তাঁর ক্যাফে— দ্য হুইস্টলিং কেটল (দার্জিলিংয়ে তাঁর চায়ের দোকানের নাম নাথমুলস)। এক টুকরো দার্জিলিংকে কলকাতায় তুলে ধরাই তাঁর লক্ষ্য। ক্যাফে নয়, এই একফালি জায়গাটিকে টি-বুটিক বলতেই পছন্দ করেন তিনি। ঢোকার মুখেই ছোট্ট জায়গায় পাওয়া যাবে মকাইবাড়ির প্রথম কুঁড়ি তোলা চা। ঢুকতে গিয়ে দেখলাম সেই চায়ের খদ্দেরদের ভিড়ে রয়েছেন শ্রীজাতও। ঠিক যে খাবারগুলি চায়ের সঙ্গে খেতে ভাল লাগে, এই ক্যাফেতে মিলবে সেগুলিই। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত আড্ডাখানা গ্লেনারিজের ঢঙে মঞ্চ করা রয়েছে। সেখানে নানা ধরনের গানবাজনার আয়োজন করা হয় সারা বছর।
পায়ের তলায় সর্ষে? হাতছানি ডাক দিচ্ছে ট্রাভেলিস্তান। ছবি: শুভেন্দু চাকী।
পূর্ব ভারতের প্রথম আর্ট-ক্যাফে আর্টসি। এমনটাই দাবি ক্যাফে মালিক মনজিৎ কউরের, যদিও গোটা উদ্যোগটায় মনজিতের প্রধান সহযোগী ছেলে অর্শদীপ সিংহ। গত আঠাশ বছর ধরে বাংলায় বসবাসকারী পঞ্জাবি আর্টসি বাঙালির নস্টালজিয়া সম্পর্কে অবগত। তাই ইন্টিরিয়র সাজানোর সময়ে মনজিৎ ব্যবহার করেছেন মায়েরই কফি মেশিন, বাবার ব্যবহৃত টাইপ রাইটার। আড্ডাধারীরা যত ক্ষণ ইচ্ছে বসতে পারেন ক্যাফের ভিতর। মনজিত বলছিলেন, ‘‘অনেকে কাজও করেন এখানে বসে। আমরা মা-ছেলে একটা ছোট বাড়ি কিনে এই ক্যাফেটাকে সাজিয়েছি। কিচ্ছু ফেলিনি, সব পুরনো জিনিস কাজে লেগে গিয়েছে ক্যাফেটা ডিজাইন করতে। লোকে এই নস্টালজিক আবহটা পছন্দ করে।’’
হিন্দুস্তান পার্কে কন্টিনেন্টাল খাবার আর নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে বসেছে ক্যাফে ড্রিফটার। গানবাজনার উপকরণ মজুত। ক্যাফেতে আসেন সব বয়সের মানুষ। রাজরূপ ভাদুড়ি তিন বছর ধরে ব্যবসা করছেন। বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে জেনেই নতুন নতুন পদ তৈরি করছেন তিনি। নিজস্বতা আনতে টাই আপ করেছেন একটি ছোট বেকারির সঙ্গে।
দু’জনে মুখোমুখি:কলকাতাতেই শৈলশহরের নির্যাস। ছবি: শুভেন্দু চাকী
ক্যারমের মতো ঘরোয়া খেলাকে প্রচার করছে যোধপুর পার্কের ক্যাফে— আবার বৈঠক। আড্ডা দিতে আসছেন যাঁরা জুটি বেঁধে তাঁরা খেলছেনও। শ্যামবাজার চত্বরে কবিতাকে অনুষঙ্গ করে গড়ে উঠেছে ক্যাফে ও কবিতা। গুণে শেষ করা যাবে না এই সব ক্যাফের সংখ্যা আর তাদের হরেক রকম থিম।
ক্যাফের ব্যবসা এত আকর্ষণীয় যে তাতে পা রাখছেন বহু নামজাদা ব্যবসায়ীও। সম্প্রতি সঞ্জয় বুধিয়াও এমন একটি উদ্যোগে সামিল হয়েছেন। ম্যাডক্স স্কোয়ারের কাছেই তাঁর ক্যাফে, ‘আই ক্যান ফ্লাই’।
কিন্তু ক্যাফেতে ভিড় জমানো নতুন প্রজন্মের আড্ডার আয়োজন কি ধরে রাখতে পেরেছে পুরনো আড্ডার চার্ম? আজকের কফিখানা কি লা ক্যাফে, ক্যাফে ডি মোনিকো, সাঙ্গুভ্যালিকে পাল্লা দিতে পারছে? প্রশ্ন শুনে হাসলেন কৌশিক সেন। অভিনেতার কথায়: ‘‘কমফর্টের সংজ্ঞাটা বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে রুচির মানে। নতুন জেনারেশন স্টারবাকস, সিসিডি-তেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তবে কফি হাউজে এখনও অনেকে যায়। ছোটখাটো আড্ডাঠেকগুলিতেও লোকে যান না এমন নয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঠেকগুলি নিজেদের বদলাতে পারেনি এ কথাও তো সত্য। আরও একটা ব্যাপার বলব কলকাতা যতটা নস্টালজিক তা ভারতের অন্য কোনও শহর নয়। সেই কারণেই পুরনো কফিখানাগুলি আজও আছে এই নতুন আড্ডার পাশাপাশি। আমি স্টারবাক্স, সিসিডি-তে যাই, তবে বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে পুরনো চা-কফির ঠেকগুলিতেও ঢুকে পড়ি। ঋদ্ধি পারিবারিক কারণে সবটাই চেনে, তবে বন্ধুদের সঙ্গে ও ক্যাফেগুলিতেই যায়।’’
আড্ডার নতুন আখড়াবাড়ি। ছবি সৌজন্যে: আর্টসি
আর একটা কারণও হয়তো আছে। সেটা খানিকটা তাত্ত্বিক। পুরনো কফি হাউস আগে ছিল সরকারের পরিচালনায়। এখন কর্মীদের সমবায়ের। ‘‘সমবায় আর সরকারি মালিকানা আজ পর্যন্ত কোথাও সফল হয়নি। নতুন ক্যাফেগুলি ব্যক্তি উদ্যোগে ব্যক্তি অর্থে এবং ব্যক্তির নিজস্ব ভাবনাচিন্তায় তৈরি। তাদের সঙ্গে দশটা-পাঁচটা করা সরকারি বা আধা সরকারি মানসিকতার প্রতিষ্ঠান পারবে কেন? যে কারণে লোকে এয়ার ইন্ডিয়ার বদলে ভিস্তারা বা ইন্ডিগো চড়ে, দূরদর্শন না দেখে বেসরকারি চ্যানেল দেখে, একই কারণে এই ক্যাফেগুলি টেক্কা দিচ্ছে’’, বললেন অর্থনীতির অধ্যাপক সেজুঁতি গুপ্ত।
ক্যাফের এই বাড়বাড়ন্ত দেখে তুমুল আশাবাদী শিলাজিৎ। পা বাড়িয়ে রেখেছেন নিজের সিউড়ির আস্তানায় একটা এমন পরিসর তৈরি করার জন্য। আনন্দবাজারকে তিনি বললেন, ‘‘আসলে আমার পছন্দ রাস্তার চা। কম বয়সে রূপবাণীর সামনের যে ঠেকটায় চা খেতাম সেটা এখনও রয়েছে। যাতায়াতের পথে আমি হাইওয়ের ধারে নানা চা আড্ডায় দাঁড়িয়ে পড়ি, তবে পছন্দের লিকার চা পাই না সেখানে। সেটার জন্য আবার ক্যাফেতেই যেতে হয়। আমি চাই এমন একটা আড্ডাখানা তৈরি করতে যেখানে সব ধরনের চা পাওয়া যাবে। ক্যাফের জনপ্রিয়তার কারণ হাওয়াবদল।’’
ছুঁতমার্গ ঝেড়ে ফেলে ক্যাফে হাতছানি দিয়ে ডাকছে সব বয়সের সব ধরনের মানুষকে। ক্যাফেতেই বসে চিত্রনাট্য পড়ছেন উদীয়মান ফিল্মমেকার, চলছে নতুন বিজনেস প্ল্যান, কানে আসতে পারে পাড়ার চায়ের দোকানের ভোট পরবর্তী বুথ সমীক্ষাও।
সন্ধে সাজছে গানে গানে: ক্যাফে ড্রিফটার
অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ কফি হাউস থেকে ক্যাফেটেরিয়ার এই যাত্রাটাকে নিয়ে উৎফুল্ল। “ক্যাফের স্মার্টনেস বাঙালি মধ্যবিত্তের অনেক সেকেলে ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে। চা তো মদ নয়, তাই অনেক বাঙালি সাহস পেয়েছে ক্যাফেতে যাওয়ার। আমাদের সিনেমায়, গল্পে, উপন্যাসে বার বার ফিরে ফিরে আসে, ‘চা খেয়ে যান’। এই কথাটার মধ্যে আসলে আড্ডার আমন্ত্রণ লুকিয়ে রয়েছে। ক্যাফে মেয়েদেরও অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। কলকাতার পুরনো কফিখানায় পুরুষের মৌরসিপাট্টা ছিল। ক্যাফেগুলি তেমন না। তা ছাড়া ক্যাফে আমাদের ডিজিটাল বেঁচে থাকার এই অবস্থাটাকে চ্যালেঞ্জ করে,” বলেন রুদ্রনীল।
কফি হাউসে এক কোণে বসে সম্পাদকীয় লিখছেন সমর সেন, আড্ডা মারছেন সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার— এমনটা আর দেখা যাবে না হয়তো। কিন্তু কে বলতে পারে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ওই কোণের টেবিলে বসা ছেলেমেয়েরাই তুমুল কিছু ভাবছে না! এই ছোট ছোট নিভু নিভু আলোর ক্যাফেগুলির একটিই হয়তো সৈয়দ মুজতবা আলীর— ক্যাফে দে জেনি! আড্ডার সিজিলমিছিল চলুক, উত্তর আসবেই।
আপনার প্রিয় ক্যাফে সম্পর্কিত গল্প, অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন আমাদের সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy