স্মৃতি: বাবার কিনে দেওয়া সাইকেল নিয়ে রৌনক। শুক্রবার, মেট্রোর ঠিক করা হোটেলে। নিজস্ব চিত্র
খুব কম সময়ের মধ্যে পর পর দু’টো বিপর্যয় নেমে এল আমাদের জীবনে। প্রথম বিপর্যয়ে গত মাসের ১৮ তারিখ বাবাকে হারালাম। দ্বিতীয় বিপর্যয়ে ঘরছাড়া হলাম। জীবন যে কত অনিশ্চিত, তা গত এক মাসের মধ্যে বুঝতে পারলাম।
শুক্রবার ভোরবেলা আশপাশের প্রতিবেশীদের আওয়াজে আমার মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। তখনও ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি। জানলা দিয়ে দেখি, পাড়ার বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে সবাই ভয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। আমাদের দোতলা বাড়ি। দ্রুত নীচে নেমে দেখি, আমাদেরও একতলার মেঝেতে বেশ ভাল রকম ফাটল ধরেছে। আমরাও আতঙ্কে রাস্তায় বেরিয়ে আসি। তবে তখনও বুঝতে পারিনি যে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।
বাড়িতে ফাটল ধরেছে বলে নিরাপত্তার কারণে বাড়ি ছাড়তে হবে, এ কথা যখন মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানালেন, তখন হতভম্ব হয়ে যাই। কিছুই বুঝতে না পেরে হাউহাউ করে আমি আর মা কাঁদছিলাম। আমাকে প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন এই বলে যে, মাকে নিয়ে তো নিরাপদ জায়গায় যেতেই হবে! তবুও মন মানছিল না। গত ১৮ সেপ্টেম্বর আমি বাবাকে হারিয়েছি। বাবার ছবিটা কিছু দিন আগে দেওয়ালে ঝুলিয়ে মালা দিয়েছিলাম। দেওয়ালে টাঙানো বাবার ওই ছবিটাই আমার কাছে সব থেকে মূল্যবান। সেই ছবি নামিয়ে, কিছু জামা নিয়ে মায়ের হাত ধরে বাইরের গলিতে চলে এলাম। আমাদের এই বিপর্যয়ের কথা আমার মাস্টারমশাই অমলবাবু জানতে পেরে ছুটে এসেছেন বৌবাজারে। মাস্টারমশাই আমাদের আগলে আগলে রাখছিলেন। তিনিই ট্যাক্সি ডেকে আনেন। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে মেট্রোর ঠিক করা হোটেলের দিকে আমরা চিন্তানিয়েই গেলাম।
সব থেকে বেশি চিন্তা হচ্ছে মাকে নিয়ে। আমি কোনও ভাবে নিজেকে সামলে নিলেও মাকে সামলানো যাচ্ছে না। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। যে দিন বাবাকে হারালাম, অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর, তার পরের দিন থেকেই আমার হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। বাড়িতে এমন বিপর্যয়ে আমার পরীক্ষা পিছিয়ে দেয় স্কুল। কবে আমার পরীক্ষা হবে, সে কথা আগামী সোমবার জানানোর কথা। কিন্তু এখন ফের এই নতুন বিপর্যয়ের মধ্যে কি আমি পরীক্ষা দিতে পারব? সোমবার স্কুলে গিয়ে স্যরদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বৌবাজারের বাড়ি থেকে হোটেলে নিজেদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস, বাবার ছবি, কিছু বই আর সাইকেলটা আনতে পেরেছি। সাইকেলটা বাবা কিনে দিয়েছিল কিছু দিন আগেই। শুধু মনে হচ্ছে, কবে ফিরে যেতে পারব নিজেদের বাড়িতে? কেউ কেউ বলছে, বাড়ি ফিরতে নাকি অনেক দেরি। নিজেদের বাড়িতে থাকলে বাবা না থাকলেও মনে হত বাবা আছে। আমার পাশেই আছে। বাড়ির বারান্দায়, ঘরে, পাড়ায় বাবার কত স্মৃতি। বাবা সেখানে আছে। কিন্তু এই হোটেলে, নতুন পরিবেশে কেমন যেন অসহায় লাগছে। বাড়ি ছাড়তে হওয়ায় বাবার অভাবটা যেন বেশি করে টের পাচ্ছি।
বৌবাজারের মদন দত্ত লেনের বাসিন্দা, অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy