আমার জন্ম রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে, আমার মামারবাড়িতে। পরবর্তী কালে বিপিন পাল রোড হয়ে এখন পাকাপাকি বাসস্থান দেশপ্রিয় পার্কের সামনে তিলক রোডে। ২০০২ সালে প্রথম দেখা এই পাড়ার চেহারা এখন আশ্চর্য ভাবে আমূল বদলে গিয়েছে। সেই রকে বসে গল্প, চা খাওয়া, মোড়ে মোড়ে আড্ডা, একে অপরের বিপদে ছুটে যাওয়া বা পার্কে বসে খোলা হাওয়ায় মন খুলে আড্ডা—আজ কোনওটাই আর নেই। এটাই বড় কষ্ট দেয়।
যখন এসেছিলাম, এ পাড়ায় তখন হইহই চিৎকার ছিল না, চলমান শব্দের দাপটও ছিল না। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হল পরিবেশের। প্রচুর লোকজন, গাড়ি, পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন ইমারত তৈরি হওয়ায় শান্ত পরিবেশটাই আর নেই। দ্রুত বদলাল এই পাড়া, বাড়তে থাকল জনসংখ্যা, দলাদলি, গাড়িঘোড়া। সবুজ মুছে যেতে লাগল। যে পাড়ায় নিশ্বাস নিতে পারতাম অবলীলায়, এখন সেখানে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিছু উঠতি বয়সের ছেলে মোটরবাইক নিয়ে তীব্র শব্দ করে উপদ্রব করায় পাড়ার শান্তি বিঘ্নিত হয়। বিশেষত রাতের দিকটায়। এদের কেউ কিছু করতেও পারে না।
এ পাড়ায় দু’টি বড় দুর্গাপুজো— দেশপ্রিয় পার্ক আর ত্রিধারা। অপূর্ব ভাবে সাজিয়ে এই দু’টি পুজোকে মনোরম করা হয়। মানুষ উৎসবে মাতোয়ারা হন। তবু আনন্দটা যেন হারিয়ে গিয়েছে। এখন পাড়ার পুজোই মনে হয় কৃত্রিম। আগে মা-কাকিমাদের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পুজোর জোগাড়যন্ত্র, আমাদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অঞ্জলি দেওয়া, একসঙ্গে বসে ভোগ খাওয়া ও পরিবেশনের আনন্দ কই?
তবুও কলকাতা আমার প্রেম। আমার পাড়া, আমার ওয়ার্ড আমার প্রেম। আমার ফ্ল্যাটটা ঠিক দেশপ্রিয় পার্কের সামনে। পার্কের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। সাজসজ্জা, গাছপালা, সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে সাজানোয় খুব ভাল লাগে। আর ঋতুর উপহার লাল কৃষ্ণচূড়া আর হলুদ রাধাচূড়ার অপরূপ সমারোহ তো আছেই। তা ছাড়া, প্রচুর গাছগাছালিতে পাখির মিষ্টি ডাকে ভরে থাকে আমার পাড়া।
আমাদের পুরপিতা দেবাশিস কুমার ওয়ার্ডটিকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার, প্রচুর আলো অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়েছে। জলনিকাশির ব্যবস্থাও এত ভাল যে গত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টির জল দাঁড়ায় না। তবে কিছু কিছু সমস্যাও আছে। জানি না কেন সে সব দিকে নজর দেওয়া হয় না। ল্যান্সডাউনের মুখে তিলক রোড শুরু হওয়ার পর থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত দু’ধারের ফুটপাথে চা, ভাত-ডালের দোকান যথেষ্ট বিড়ম্বনা দেয়। এছাড়াও বাড়ি তৈরির জন্য পাহাড় করে রাখা বালি, সিমেন্ট, স্টোনচিপ্সে দখল হয়ে থাকে ফুটপাথ। পাশে গাড়ি সারানোর দোকানে গাড়িও দাঁড়িয়ে থাকে ফুটপাথ জুড়ে। পথচলা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এই বয়সে পৌঁছে ফুটপাথে হাঁটা প্রায় ভুলে গিয়েছি। হাঁটতে হলে রাস্তায় নামতে হয়। যে ভাবে বেপরোয়া গাড়ি চলে, তাতে প্রতি মুহূর্তে দুর্ঘটনার ভয় থাকে। এটাই আমার ওয়ার্ডের বিরাট সমস্যা। এমন ঐতিহ্যবাহী পাড়ায় এ সব মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। তবে এখন মনে হয় আমাদের এ সব মানতেই হবে, রাজনীতির স্বার্থে।
আজকাল নতুন দোকানেরও রমরমা। রোজই দেখি এখানে-ওখানে নতুন রেস্তোরাঁ খুলছে, বা জামাকাপড়ের দোকান। আমার পাড়ায় এখন ফ্ল্যাটবাড়ির কালচার। কেউ কাউকে চিনি না। আমিও যেন বাড়ির কালচার ভুলে যেতে বসেছি। দুঃখ হয়। আগে যেমন আকাশ দেখা যেত, এখন যেন গগনচুম্বী ইমারতের আড়ালে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। উঁচু বাড়ির ফাঁক দিয়ে যেটুকু তার দেখা পাওয়া।
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy