বিধান সরণি শীতলা মন্দিরের বিগ্রহ। নিজস্ব চিত্র।
অতিরিক্ত সংক্রমণ আর কল্পনাতীত আতঙ্ক, করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে এই দুই-ই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে জনজীবনকে। সঙ্গে টিকাসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা। তার মধ্যে অতিমারি-কালে সরকারি নানা বিধিনিষেধ। অতীতে বিভিন্ন মহামারির সময়ে এই শহরই মা শীতলার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত।
‘থাকত’ নয়। এখনও থাকে। থাকছে। শনিবার শীতলাপুজোর দিন তেমনই দেখতে পেল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
গুটি বসন্তের ত্রাতা দেবী হিসাবেই শীতলার পরিচয় ‘বসন্তের দেবী’ হিসেবে। পরে যদিও কলেরা, প্লেগ-সহ যে কোনও মহামারির ক্ষেত্রে মানুষ শরণাপন্ন হয়েছেন তাঁর। দেবীর এক হাতে ঝাঁটা। অন্য হাতে জলের ঘট। ভক্তদের ব্যাখ্যায়, ওই ঝাঁটা দিয়ে দেবী সমস্ত জীবাণু নষ্ট করে জল দিয়ে রোগ নির্মূল করেন। প্রাক্তন আমলা জহর সরকার অবশ্য বলেন, ‘‘গুটিবসন্ত বিদায় নিয়েছে। কিন্তু মা শীতলা গাধায় চড়ে নিয়মিত আসছেন এবং ঝাঁট দিচ্ছেন।’’
বসন্ত গিয়েছে। করোনা এসেছে। এই অতিমারিতেও এলাকার মানুষ শরণ নিচ্ছেন দেবী শীতলার।
করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে কি শীতলা মন্দিরে ভিড় বাড়ছে? বিধান সরণি শীতলা মন্দিরের নাটমন্দিরে বসে থাকা বৃদ্ধাকে শনিবার প্রশ্নটা করতেই তিনি ডাকলেন এক মহিলাকে। মন্দিরের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন যিনি, তাঁর নাম পাপিয়া মুখোপাধ্যায়। এটি তাঁদেরই পারিবারিক মন্দির। পাপিয়া বললেন, ‘‘অতিমারি পরিস্থিতিতে অনেকেই আসছেন পুজো দিতে। নিজেদের মঙ্গলকামনা করছেন মা শীতলার কাছে। মন্দির তো বন্ধ রাখা যায় না। লকডাউন হলেও নয়। তবে ভক্তদের জন্য দূরত্ববিধি মানা হবে।’’
মন্দিরে পুজো দিতে আসা মানসী দত্ত যেমন বলছিলেন, ‘‘মহামারির সময়ে তো চিরকাল শহরবাসীকে রক্ষা করেন মা শীতলা। মায়ের কাছে রোজই পুজো দিই। তবে এই বিশেষ দিনে আমি মায়ের কাছে মানত করেছি— সকলকে করোনা থেকে রেহাই দাও।’’
বিধান সরণির উপরে ‘বর্ণপরিচয়’-এর ঠিক উল্টো দিকে ফুটপাতের উপর শীতলা মন্দির। নিজস্ব চিত্র।
বিধান সরণির উপরে ‘বর্ণপরিচয়’-এর ঠিক উল্টো দিকে ফুটপাতের উপর শীতলা মন্দির। গত কয়েক দিনের তুলনায় ভিড় বেড়েছে বৈশাখের শেষ শনিবার। বহু পথচলতি মানুষ একটু দাঁড়িয়ে বিগ্রহকে প্রণাম করে চলে যাচ্ছেন। মন্দির চত্বরে কোনও কোলাহল নেই। মন্দিরের সামনে এক ফুলবিক্রেতা পসরা নিয়ে বসে আছেন। তার কাছেই বাটি হাতে ভিক্ষুক। মন্দিরের সামনে মাটি লাগানো কাঠের বেদীতে ধূপকাঠি, মোমবাতি, সিঁদুরের উপস্থিতি বলে দিচ্ছে ভক্তদের আনাগোনা কেমন! মন্দিরের ভিতরে কয়েক জন বসে। পুজো দেবেন। পুরোহিতের অপেক্ষায় ওঁরা। কলকাতা শহরের শীতলা মন্দিরগুলির মধ্যে এটির বেশ নামডাক। এ মন্দিরের প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। পাপিয়ার কথায়, ‘‘যাতায়াতের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে বিশ্রাম নিতেন। তখন মন্দির ছিল আটচালা। প্রতিমা তুলে পুজো হত। পরে মা’কে প্রতিষ্ঠা করা হয়।’’
ঘটনাচক্রে, শনিবারই ছিল শীতলাপুজো। গত বছর লকডাউনের সময় আনন্দবাজার ডিজিটাল গিয়েছিল বিধান সরণির শীতলা মন্দিরে। সামনের শাটার ছিল বন্ধ। তবে নিত্যপুজো বন্ধ হয়নি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় আনন্দবাজার ডিজিটাল ফিরে গেল সেই মন্দিরে। চোখে পড়ল শরণার্থীদের চেনা আনাগোনা। শতাব্দীর পর শতাব্দী বসন্ত, কলেরা, প্লেগের মতো মহামারি থেকে শহরবাসীকে এই দেবীই রক্ষা করেছেন বলে মানুষের বিশ্বাস। আর শনিবার যথেষ্ট ভিড় দেখা গেল উত্তর কলকাতার একাধিক শীতলা মন্দিরে। পুজো-অর্চনার সঙ্গেই সমবেত কামনার উতরোল। ঘটনাচক্রে, সেদিনই রাজ্য জুড়ে কার্যত লকডাউনই ঘোষণা করা হল।
উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের একেবারে গায়ে বিধান সরণির শীতলা মন্দির সারা বছর খোলা থাকে। কিন্তু গত বছরের লকডাউনের সময় ভক্তদের জন্য নানা বিধিনিষেধ ছিল। অনেক সময় মন্দিরের শাটার নামানোই থাকত। ভিড়ও তেমন হত না। কিন্তু সেই মন্দিরেই এ বার প্রার্থনাকামীদের আসা-যাওয়া বেড়েছে। বিশেষত, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। একই ছবি কাছের বসাকবাগান লেন এবং পার্বতী ঘোষ লেনের শীতলা মন্দিরেও। শনিবার ওই দুই মন্দিরেই জাঁকজমক করে পুজো এবং মঙ্গলকামনা চলল দিনভর। অতিমারিতে গর্দভবাহন দেবীর শরণ নিয়েছেন এলাকাবাসী।
পার্বতী ঘোষ লেনের শীতলা মন্দিরেও শনিবার জাঁকজমক করে পুজো এবং মঙ্গলকামনা চলল দিনভর। নিজস্ব চিত্র।
এমনিতেই এ সব মন্দিরে সারা বছর পুজো হয়। তবে চৈত্র, বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে আলাদা করে দিন-ক্ষণ দেখে পুজো হত। একটা সময়ে বসন্তের শেষে আর গ্রীষ্মের আগে শহরে শুরু হত গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাব। সেই কারণেই এই বসন্ত-গ্রীষ্মের মধ্য সময়ে দেবী শীতলার বিশেষ পুজো হয়ে আসছে। ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ উল্লেখ আছে, ১৮৪৯-’৫০ সালে ১৬ মাসের গুটিবসন্তের মহামারিতে কলকাতা শহরে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৬,১০০ জন। ১৮৫০ সালে স্মল পক্স কমিশনারের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৮৩২ থেকে প্রতি ৪-৫ বছরের ব্যবধানে গুটিবসন্ত মহামারির আকার নিয়ে ফিরে এসেছে কলকাতায়। সেই মহামারি প্রায় ১৬ মাস ধরে থাকত। প্রায় ১৪,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন শহরে। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর, কলুটোলা, মুচিপাড়া, তালতলা, বড়তলা এলাকায় প্রাণ হারিয়েছিলেন সব চেয়ে বেশি মানুষ। সে কারণেই উত্তর কলকাতায় শীতলা মন্দিরের সংখ্যা বেশি। তবে অতিমারি বলে গত বছর ওই সব মন্দিরে বড় করে পুজো হয়নি। এ বার হয়েছে এবং হচ্ছে। বিধান সরণির মন্দিরে যেমন বৈশাখের প্রথম শনিবার ঘটা করে শীতলার পুজো হয়েছে। অনেক মানুষ এসেছিলেন। বৈশাখের শেষ শনিবার বসাকবাগান ও পার্বতী ঘোষ লেনের শীতলা মন্দিরে পুজো হয়। সেই মতো শনিহার ওই দুই মন্দিরে করোনা-কালে ভক্তরা এসেছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লেন মন্দিরের পুরোহিত সমর ভট্টাচার্য। তিনি জানালেন, দিনে চার বার নিয়ম করে পুজো হয় মায়ের। সকালে আরতি দিয়ে মায়ের ঘুম ভাঙানো হয়। তার পর ৯-১০টা নাগাদ শুরু হয় পুজো। তখন থেকে দুপুর পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। তখনই ভক্তরা আসেন পুজো দিতে। দুপুরে মাকে ভোগও নিবেদন করা হয়। তার পর মায়ের বিশ্রামের জন্য বন্ধ থাকে মন্দির। ফের সন্ধ্যায় আরতির সময় খোলা হয় মন্দির। রাতের পুজো শেষে মন্দির বন্ধ। সমরের কথায়, ‘‘আমাদের বাৎসরিক পুজো হয় বৈশাখের প্রথম শনিবার। তখন তো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে গিয়েছে। সে দিন তো উপচে গিয়েছিল মন্দির। এখনও আসছেন। তবে ওই দিনের তুলনায় তা কিছুই নয়।’’
অন্যান্য বছরের মতো না-হলেও বৈশাখের শেষ শনিবারে বসাক বাগান লেনে ধুমধাম করেই হচ্ছে মা শীতলার পুজো। নিজস্ব চিত্র।
বিধান সরণি থেকে কিছুটা গেলেই আরও একটি শীতলা মন্দির রয়েছে বসাক বাগান লেনে। অন্যান্য বছরের মতো না-হলেও বৈশাখের শেষ শনিবার এখানে ধুমধাম করেই হচ্ছে মা শীতলার পুজো। এই মন্দিরটিও শতাব্দী প্রাচীন। এলাকার বাসিন্দা প্রদীপ দাসের দাবি, ‘‘১২৮৮ বঙ্গাব্দ থেকে এই মন্দিরে পুজো হয়ে আসছে।’’ পুরোহিত শঙ্করপ্রসাদ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘প্রায় ৩৫ বছর ধরে এই মন্দিরে পুজো করছি। আমার পূর্বপুরুষরাও এই মন্দিরেই পুজো করতেন। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ শনিবারে বড় করে পুজো হয়। কলকাতার অনেক শীতলা মন্দিরেই এই চল আছে।’’ তবে বাৎসরিক পুজো বলেই শনিবার ভিড়টা একটু বেশি হয়েছে বলে মানছেন শঙ্করপ্রসাদ।
প্রায় ১০০ বছর ধরে পুজো হয় উত্তর কলকাতার পার্বতী ঘোষ লেনের শীতলা মন্দিরে। শনিবার সেখানেও ছিল বিশেষ পুজো। প্রতি বছর প্রতিমা তুলে হয় পুজো। এ বছর করোনার কারণে শুধু ঘটপুজো হচ্ছে। সকাল থেকে ভক্তদের লাইন চোখে পড়ার মতো। এটিও পারিবারিক মন্দির। সেই পরিবারের সোমা দাস বলছিলেন, ‘‘অন্য বছর পাঁচ দিন ধরে চলে পুজো অনুষ্ঠান। বলি দেওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। এ বছর করোনার কারণে সে সব বন্ধ।’’
লোককথায় তো দেবী শীতলার সঙ্গে মহামারির তো অবিচ্ছেদ্য যোগ! সেই ঐতিহ্য সমানে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy