এরকম ফুটপাত জুড়ে থাকা ডালা থেকেই ছড়িয়েছিল বাগড়ির আগুন। —নিজস্ব চিত্র।
রবীন্দ্র সরণি ধরে ময়ূর সিনেমা হল পেরনোর পর থেকেই রাসায়নিক পোড়া ঝাঁঝালো গন্ধের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বাঁ দিকে ঘুরে ক্যানিং স্ট্রিট ধরতেই চোখে পড়ল ভয়ানক সব চিত্র।
এক দিকে পুলিশ আর দমকলকর্মীদের আগুন নেভানোর মরিয়া চেষ্টা। অন্য দিকে, তার থেকেও মরিয়া ব্যবসায়ীরা প্রাণ হাতে করে জ্বলন্ত বাজারের ভিতরে ঢুকে বার করে আনছেন একের পর এক বস্তা। যে যতটা পারছেন, সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন নিজেদের জীবনের রসদ।
সেই তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেই সোমবার সকালে চোখ আটকে গেল এক প্রৌঢ়কে দেখে। পুলিশের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদ তাঁর। দমকলের একটা হোস প্রবল আক্রোশে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন ওই প্রৌঢ়। তা থেকেই বাদানুবাদের শুরু বলে শোনা গেল। অন্য ব্যবসায়ীরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে নিরস্ত করার পর তিনি পাশের একটি দোকানের শাটার তুললেন।
আরও পড়ুন
জ্বলছে বাগড়ি মার্কেট, তার মধ্যেই ভবানীপুরের বহুতলে আগুন, তীব্র আতঙ্ক
পোড়া স্তূপের মধ্যে থেকে চশমার ফ্রেম বার করছেন জয়নাল আবেদিন। —নিজস্ব চিত্র।
খুলতেই দেখা গেল, পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া একটি আট ফুট বাই আট ঘর। ঘরের মধ্যে থরে থরে যেন পোড়া কয়লা সাজানো। শাটার ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই কালো কয়লার স্তূপের একটা অংশ ঝরে পড়ল বাইরে। তত ক্ষণে প্রৌঢ়ের নাম জানা গিয়েছে— জয়নাল আবেদিন। দোকানের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত হতবাক থেকে সেই ছাইয়ের স্তূপের উপরেই বসে পড়লেন। কোনওক্রমে তাঁকে সামলানোর চেষ্টা করছেন তাঁর ছেলে মহম্মদ জায়েদ। ভবানিপুর এডুকেশন সোসাইটির প্রথম বর্ষের ছাত্র জায়েদ তখন ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন দমকলকর্মীদের উপর। ওই তরুণের দাবি, শনিবার রাতে তাঁদের দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল দমকলের গাড়িটা। জায়েদ বলেন, “তখন বাইরের ডালা থেকে আগুনটা আমাদের দোকানের দিকে শাটারের তলা দিয়ে ছড়াচ্ছে। বার বার বলেছিলাম, জল দিতে। তখন কেউ শুনল না।”
জায়েদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নজর পড়ল তাঁর বাবার দিকে। প্রাথমিক আকস্মিকতা কাটিয়ে তখন সেই পোড়া স্তূপের মধ্যে থেকে একের পর এক প্যাকেট বার করছেন প্রৌঢ়। সযত্নে বার করা সেই ‘ছাই’ ধুয়ে দেখা গেল প্যাকেটগুলোতে রয়েছে চশমার ফ্রেম। ছাইয়ের মধ্যে থেকেই জয়নাল যতটা পারছেন বাঁচানোর চেষ্টা করছেন দোকানের মালপত্র।
আরও পড়ুন
এখনও জ্বলছে বাগড়ি মার্কেট, চার ও পাঁচ তলায় আগুনের হলকা, নেভানোর চেষ্টা জারি
আগুন মাথায় নিয়েই জিনিস বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা ব্যবসায়ীদের। —নিজস্ব চিত্র।
জয়নালের দোকানের সামনেই সিইএসসি-র একটা ফিডার বক্স। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহম্মহ রিয়াজ। কলুটোলায় বাড়ি। বাগড়ি বাজারের ই-ব্লকের ফটকের সামনেই তাঁর প্লাস্টিকের ডালা ছিল। শনিবার রাতের ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শীও তিনি। তাঁর কথায়, “আমি যখন এসে পৌঁছলাম তখন জায়েদদের চশমার দোকানের সামনে রাস্তার উপরের তারে আগুনের ফুলকি জ্বলছিল। সেই ফুলকি নীচের প্লাস্টিকে মোড়ানো ডালায় পড়ে।” রিয়াজের দাবি, “ওই ডালাটা আসলে কড়েয়ার মহম্মদ শাহজাহানের। ওর আরও একটা ডালা আছে। তাই দু’বছর আগে রাজু বলে এক জনকে ভাড়ায় এই ডালা চালাতে দেয়। রাজু মূলত সুগন্ধির ব্যবসা করত।”
রিয়াজের মতোই তখন সেখানে হাজির আরও ব্যবসায়ী। তাঁরা বলেন, ‘‘আগুনের ফুলকি ওই ডিওডর্যান্টের উপর পড়তেই প্রবল বিষ্ফোরণ হয়। মুহূর্তে আগুন ছড়ায়। একটি জ্বলন্ত ডিওডর্যান্টের টিন উড়ে গিয়ে পড়ে উল্টোদিকের রাস্তায় একটি দোকানে। সেখানেও আগুন লেগে গিয়েছিল। সেই আগুন তখন নেভানো গেলেও রাস্তার এ পারে তত ক্ষণে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। জ্বলছে একের পর এক ডালা। পারফিউম আর ডিওডর্যান্টের ডালার আগুন তখন ফুটপাথ ছাড়িয়ে বাজারের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে।
আরও পড়ুন
পুলিশ-দমকলের ভূমিকা বাগড়ির ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ বাড়াচ্ছে
মহম্মদ শামি, এ রকমই এক জন ডালা ব্যবসায়ী এ দিন বলেন, “এই মার্কেটে ২২ জন নিরাপত্তারক্ষী। অথচ যখন আগুন লাগল, তখন এক জন ছাড়া কাউকে খুঁজে পাইনি। মার্কেটের দরজা তখন খুলে দিলে অনেক আগেই দমকল ভেতরে ঢুকতে পারত। আগুন এত বড় আকার নিতে পারত না।”
শামি, রিয়াজের সঙ্গে কথা থেকেই সামনে এল, বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে মালিক পক্ষের শনিবারই একটা মিটিং ছিল। কারণ গত কয়েক মাস ধরেই বাগড়ির মালিকানা নিয়ে একটা সমস্যা চলছিল। এক ব্যবসায়ী বলেন, “বাগড়ি বাজারের মূল মালিক ছিলেন মোহন বাগড়ি। পরে সেই মালিকানা যায় রাধা বাগড়ি এবং বরুণ রাজ বাগড়ির কাছে। সম্প্রতি বাগড়ি এস্টেট লিমিটেডে আরও কয়েক জন অংশীদার যুক্ত হন। আর সেই থেকেই গন্ডগোলের শুরু।”
মহম্মদ রিয়াজ। বাগড়ির ব্যবসায়ী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। —নিজস্ব চিত্র।
জায়েদও অভিযোগ করেন, গত কয়েক মাস ধরে তাঁরা ভাড়ার রসিদ পাচ্ছিলেন না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই মালিকানা নিয়ে টানাপড়েনের জেরেই ভাড়াটে দোকানদাররা টাকা দেওয়া সত্ত্বেও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল। শুকনো খটখটে ছিল কয়েক লাখ টাকা দিয়ে বানানো জলের ট্যাঙ্ক। যদিও আগুন লাগার পর রাধা বাগড়ির বালিগঞ্জ প্লেস বা আলিপুরের আত্মীয়ের বাড়িতে হদিশ মেলেনি কারও। এক ব্যবসায়ীর দাবি, “পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী তিনি রবিবার সকালেই দেশের বাইরে পাড়ি দিয়েছেন।”
বেলা তিনটে। মাথার উপর বাড়ির পূর্ব দিকের কোণে চার তলা থেকে ফের কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দমকলের এক শীর্ষ কর্তা খালি হাতের তালু উল্টে ইঙ্গিত করলেন, তাঁরাও বুঝতে পারছেন না আরও কত ক্ষণ লাগবে আগুন নিভতে।
আরও পড়ুন
ফের যেন অগ্নিপরীক্ষা, পুড়ে ছাই বাগড়ি বাজার, পুজোর আগে সর্বস্বান্ত বহু
কিন্তু ক্ষোভের আগুন জ্বলছে ব্যবসায়ীদের একাংশের মধ্যে। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা টাকা দিই অগ্নিসুরক্ষার জন্য। মালিক সেই কাজ না করেও সাময়িক লাইসেন্স পায়। পুরসভা দিয়ে দেয়।’’ অন্য দিকে, রাস্তার দু’পাশে সার সার বন্ধ ডালার দিকে আঙুল তুলে জায়েদ এবং অন্য ব্যবসায়ীরা বলেন, “এদের তো কোনও নিয়মকানুনের বালাই নেই। এদের ফায়ার সেফটি লাইসেন্সও লাগে না। এরা তো সব কিছুরই ব্যবসা করছে।”
ডালা ব্যবসায়ীরাও দাবি করেন, তাঁদের হকার লাইসেন্স আছে। যদিও পুলিশকেও পয়সা দিতে হয় বলে অভিযোগ। তাঁদের এক জনই যেমন বলেন, “লাইসেন্স থাকলেও মাসে মাসে স্থানীয় থানাতে একটা নির্দিষ্ট টাকা দিতে হয়।”
আসলে, পুরসভা থেকে শুরু করে দমকল— সবার চোখের সামনেই চলে বেআইনি এই কারবার।
(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy